আলহামদু লিল্লাহ।.
এক:
এগুলো গায়েবী বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত; যেগুলোর প্রতি একজন মুসলিমের আত্মসমর্পন করা আবশ্যক। এগুলোর ধরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা না করা। কারণ বারযাখের জীবনের ধরণ ও স্বরূপ সম্পর্কে আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ জানে না।
রূহ অন্য সব মাখলুকের মত সৃষ্টি। এর স্বরূপ জানা আল্লাহর জন্য খাস। এর জ্ঞানকে আল্লাহ্ নিজের জন্য একনিষ্ঠ করেছেন; যেমনটি আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রাঃ) এর হাদিসে এসেছে যে তিনি বলেন: একবার আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে একটি ক্ষেতের মাঝে উপস্থিত ছিলাম। তিনি একটি খেজুরের লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়েছিলেন। এমন সময় কিছু সংখ্যক ইহুদী যাচ্ছিল। তারা একে অপরকে বলতে লাগল: তাঁকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর। কেউ বলল: কেন তাকে জিজ্ঞেস করতে চাইছ? আবার কেউ বলল: তিনি এমন উত্তর দিবেন না, যা তোমরা অপছন্দ করবে। তারপর তারা বলল যে, তাঁকে প্রশ্ন কর। এরপর তারা তাঁকে রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করল। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম (উত্তরদানে) বিরত থাকলেন, এ সম্পর্কে তাদের কোন উত্তর দিলেন না। (বর্ণনাকারী বলেন) আমি বুঝতে পারলাম: তাঁর ওপর ওহী অবতীর্ণ হবে। আমি আমার জাযগায় দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর যখন ওহী অবতীর্ণ শেষ হল, তখন তিনি বললেন:
وَيَسْئَلُوْنَكَ عَنِ الرُّوْحِ قُلِ الرُّوْحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّيْ وَمَآ أُوْتِيْتُمْ مِّنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيْلًا
(আর তারা আপনাকে ‘রূহ’ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। আপনি বলে দিন; রূহ আমার প্রভুর বিষয়। তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞান দেয়া হয়েছে।)[সহিহ বুখারী]
আল্লাহ্ তাআলা তাঁর কিতাবে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সুন্নাহতে রূহের কিছু বিশেষণ উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে: কবজ ও মৃত্যু এবং রূহকে বেড়ি পরানো, কাফন পরানো এবং রূহের আগমন ও প্রস্থান, রূহ ঊর্ধ্বে উঠা ও নীচে নামা। চুলকে যেভাবে আঠা থেকে টেনে বের করা হয় ঠিক সেভাবে রূহকে টেনে বের করা হয়...। সুতরাং আবশ্যক হলো দুই ওহীতে উল্লেখিত এই বিশেষণগুলো সাব্যস্ত করা; তবে এর সাথে জেনে রাখা উচিত: রূহ দেহের মত নয়।
শাইখ বিন উছাইমীন (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:
নিশ্চয় মানুষের মৃত্যু মানে দেহ থেকে রূহ বেরিয়ে যাওয়া। যখন কবরে দাফন করা হয় তখন কি রূহকে দেহে ফিরিয়ে দেয়া হয়; নাকি কোথায় যায়? যদি কবরে রূহকে দেহে ফিরিয়ে দেয়া হয় তাহলে কিভাবে সেটা ঘটে?
জবাবে তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, যখন মানুষ মারা যায় তখন কবরে তার কাছে রূহকে ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং তাকে তার প্রভু, তার ধর্ম ও তার নবী সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। যারা অবিচল বাণীর প্রতি ঈমান এনেছে তাদেরকে আল্লাহ্ দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে অবিচল রাখেন। তখন সে ব্যক্তি বলে: আমার প্রভু আল্লাহ্, আমার ধর্ম ইসলাম এবং আমার নবী মুহাম্মদ। পক্ষান্তরে কাফের কিংবা মুনাফিককে যখন জিজ্ঞেস করা হয় তখন সে বলে: হায় হায়; আমি জানি না। আমি শুনেছি লোকেরা কিছু একটা বলে আমিও সেটা বলেছি।
এই ফিরিয়ে দেয়া অর্থাৎ কবরে মানুষের দেহে রূহকে ফিরিয়ে দেয়াটা দুনিয়াতে মানুষের দেহে রূহ থাকার মত নয়। কেননা সেটি বারযাখের জীবন; আমরা এর স্বরূপ সম্পর্কে জানি না। কেননা এই জীবনের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে আমাদেরকে জানানো হয়নি। প্রত্যেক গায়েবী বিষয়; যেগুলো সম্পর্কে আমাদেরকে জানানো হয়নি সেগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো: (দলিলের গণ্ডিতে) থেমে যাওয়া। যেহেতু আল্লাহ্ তাআলা বলছেন: “আর যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না; কান, চোখ, হৃদয়— এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।”[সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ৩৬] শাইখ [উছাইমীনের ফাতাওয়া নুরুন আলাদ দারব (২/৪)]
দুই:
মৃতব্যক্তি তাকে গোসল দেয়াকালে কিংবা কবরে নেওয়ার সময় তার দেহ দেখতে পায় না। যেহেতু তার রূহ বেরিয়ে গেছে এবং তার রূহ কবরে পরীক্ষার সময় ছাড়া কখনও দেহে ফিরিয়ে দেয়া হয় না।
রূহের পরিণতি: নিশ্চয় মুমিনের রূহ যখন আসমান থেকে নামে তখন তার দেহে ফিরিয়ে দেয়া হয়; যেই দেহে ছিল। এরপর সেই ব্যক্তিকে কবরে প্রশ্ন করা হয়। তখন আল্লাহ্ অবিচল বাণীর মাধ্যমে তাকে অবিচল রাখেন এবং তার জন্য কবরকে দৃষ্টি যতদূর যায় ততটুকু প্রশস্ত করে দেন।
আর কাফেরের রূহকে ফেরেশতারা জাহান্নাম ও আল্লাহ্র অসন্তুষ্টির সুসংবাদ দেয়। এরপর সেটাকে উপরে নিয়ে যাওয়া হয় কুশ্রী, হীন ও ভীত অবস্থায়। তার জন্য আসমানের দরজাগুলো খোলা হয় না। এরপর তাকে তার দেহে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তখন কবরে তাকে প্রশ্ন করা হয়। তার কবরকে সংকীর্ণ করে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের আগুনের উত্তপ্ততা ও তাপ তার দিকে আসতে থাকে।
এর বিস্তারিত বিবরণ বারা বিন আযেব (রাঃ) এর লম্বা হাদিসে এসেছে। আমরা সেই হাদিসটি এর সভাষ্যে 8829 নং প্রশ্নোত্তরে উল্লেখ করেছি।
আর প্রশ্ন করাকালে রূহকে দেহে ফিরে আসা: এটি বিশেষ ধরণের ফিরে আসা। এটি দুনিয়ার ফিরে আসার মত নয়; যেমনটি পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে। বরং এটি বারযাখী ফিরে আসা। তার জীবন, তাকে প্রশ্ন করা ও জবাব দেয়া সবই বারযাখী অবস্থা; দুনিয়ার অবস্থার মত নয়। আল্লাহ্ই এর স্বরূপ ও পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক অবগত।
শাইখ ইবনে উছাইমীন বলেন:
প্রিয় ভাইয়েরা, আল্লাহ্ আমাদেরকে যে সব গায়েবী বিষয় জানিয়েছেন সেগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের উপর ওয়াজিব হলো এই কথা বলা: ‘আমরা ঈমান আনলাম ও বিশ্বাস করলাম’। নানারকম আপত্তি তোলা নয়। কারণ বিষয়টি আমাদের বিবেকবুদ্ধির ঊর্ধ্বে। আল্লাহ্ ও তাঁর মাখলুক সংক্রান্ত গায়েবী বিষয়ে এটাই হলো একটি সূত্র।
গায়েবী বিষয়ের ক্ষেত্রে এই কথা চলে না: কেন? এবং এই কথাও চলে না: কিভাবে? কারণ বিষয়টি আমাদের বিবেক-বুদ্ধির ঊর্ধ্বে। এ কারণে যখন তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল তখন তিনি তাদেরকে কী বলেছিলে? তিনি বলেছিলেন:
قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي
(আপনি বলুন, রূহ আমার প্রভুর বিষয়)। এমন বিষয় যা তোমরা অবগত হতে পারবে না।
وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا
(তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞান দেয়া হয়েছে)।[সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ৮৫] সুবহানাল্লাহ্! অর্থাৎ তোমরা কি রূহের জ্ঞান ছাড়া বাকী সব জ্ঞান পেয়ে গেছ?!! অধিকাংশ জ্ঞানই তোমাদের জানা নেই। তোমাদেরকে যৎ সামান্য জ্ঞান দেয়া হয়েছে। এটি বিস্ময়কর! আপনার রূহ আপনার দুই পার্শ্বের মধ্যে যার অস্তিত্ব, যা ছাড়া আপনি অস্তিত্বহীন; সেটা কি আপনি তাইই জানেন না?! আমরা রূহের ব্যাপারে ততটুকুই জানি যতটুকু কুরআন-সুন্নাহ্র দলিলে উদ্ধৃত হয়েছে। তা ছাড়া আমরা কিছুই জানি না।[লিকাআতুল বাব আল-মাফতুহ (১৬৯) থেকে সমাপ্ত]
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।