রবিবার 21 জুমাদাল ছানী 1446 - 22 ডিসেম্বর 2024
বাংলা

শৌচকার্যে ব্যবহৃত পানি পেশাবের রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে বেরিয়ে যাওয়া

প্রশ্ন

‌আমি অনলাইনে ইসলামিক ওয়েবসাইটে বেশ কিছু ফতোয়া পড়েছি যেগুলোর মোদ্দাকথা হলো, শৌচকার্যের পানি যদি পেশাবের রাস্তা দিয়ে ঢুকে আবার বের হয়, তাহলে এটি নাপাক এবং এটি অযু ভেঙে দেয়। বিষয়টি আমাকে খুব দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। কারণ আমি গোসল বা শৌচকার্য করার সময় লক্ষ্য করি যে কিছু পানি আমার পুরুষাঙ্গের ছিদ্র দিয়ে ঢুকে সেখানে থেকে যায়। তারপর সেখান থেকে বের হয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই। বরং এটি শতভাগ নিশ্চিত বিষয়। আমি একজন ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে এটি মূত্রনালিতে প্রবেশ করে না। অর্থাৎ পানি শুধু পুরুষাঙ্গের ছিদ্রেই ঢুকে থাকে। কিন্তু সেটি মূত্রনালিতে ঢুকে না। তাছাড়া আমি লক্ষ্য করেছি যে আমার পুরুষাঙ্গের ছিদ্র সবসময় সিক্ত থাকে। সেটি শৌচকার্য ও গোসলের সময় ছাড়া অন্যান্য সময়েও। অনেক গবেষণা করে এবং একজন ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করার মাধ্যমে আমি জানতে পেরেছি যে, পুরুষাঙ্গের ভেতরের দিকে একটি শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি রয়েছে যেটি এই জায়গাকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই সিক্ততা নির্গত করে। মুখের ভেতরের লালার মতই এর অবস্থা। এই সিক্ততা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা নেই। কারণ এটি পুরুষাঙ্গের ছিদ্র থেকে বের হয় না। কিন্তু সমস্যা হলো এই সিক্ততা মুত্রানালিতে থাকে। অর্থাৎ নাপাকির স্থানে। গোসল অথবা শৌচকার্য করার সময় কিছু পানি পুরুষাঙ্গের ছিদ্রে ঢুকে যায়। ফলে এই সিক্ততার সাথে মিশে যায়। আমার প্রশ্নের দুটি অংশ: প্রথমতঃ গোসল অথবা শৌচকার্য করার সময় পুরুষাঙ্গের ছিদ্র দিয়ে যে পানি ঢুকে সেটি কি পুরুষাঙ্গের ভেতরে থাকা যে সিক্ততার উপর দিয়ে পেশাব প্রবাহিত হয়েছে সেটির সাথে মিশে যাওয়ার কারণে নাপাক?! দ্বিতীয়তঃ এটা কি বলা সম্ভব যে, পুরুষাঙ্গের ছিদ্র দিয়ে যে পানি প্রবেশ করে বের হয় না, সেটি অযু ভেঙে দেয় না। যেহেতু এটি মূত্রনালিতে প্রবেশ করে না; কেবল পুরুষাঙ্গের ছিদ্রে প্রবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে?! অর্থাৎ অযু ভাঙার ক্ষেত্রে কি মূত্রনালি বিবেচ্য; নাকি পুরুষাঙ্গের ছিদ্র?!

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

যে ব্যক্তি তার মূত্রনালিতে পানি অথবা তেল অথবা অন্য কিছু প্রবেশ করানোর পর সেটি বেরিয়ে গেছে সে পানি নাপাক হয়ে যাবে এবং তা অযুকে নষ্ট করবে।

ইবনে কুদামা রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “যদি তার মূত্রনালিতে ফোটা ফোটা করে তেল ঢুকায় তারপর সেটি বেরিয়ে যায়, তাহলে তার অযু ভেঙে যাবে। কারণ এটি পেশাবের রাস্তা দিয়ে বের হয়েছে। আর প্রত্যেক সিক্ততার সাথেই নাপাকি থাকে; যা অযু ভেঙে দেয়। যেমনিভাবে কেবল নাপাকি বের হলে অযু ভেঙে যায়।”[সমাপ্ত][আল-মুগনী (১/১২৫)]

এ কথা সে ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে যখন পানি ভেতরের কোনো কিছুতে প্রবেশ করবে; যখন সেটি বের হওয়াটা পেশাবের রাস্তা দিয়ে বের হওয়া বলে গণ্য হবে।

আর যদি পুরুষাঙ্গের সম্মুখভাগের পবিত্র ছিদ্রতে প্রবেশ করে; ভেতরে না যায় তাহলে (পবিত্রতায়) প্রভাব ফেলবে না।

আর আপনি যা উল্লেখ করেছেন সেটি ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ পেশাবের রাস্তার ভেতরে পানি প্রবেশ করা অসম্ভব, যদি ব্যক্তি জোর করে সেটি প্রবেশ না করিয়ে থাকে!!

যদি ধরে নেয়া হয় যে, এমনটি ঘটেছে, তাহলে আপনি গোসল করার পর প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে পানি দিয়ে শৌচকার্য করে নিবেন। পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ পানি দিয়ে ধুয়ে নিবেন। ঘাটাঘাটি ও খোঁজাখুঁজি করবেন না। এর বেশি কিছু করার দায়িত্ব আপনার উপর নেই। অন্যথায় আপনি আপনার মনের ভেতর ওয়াসওয়াসার দরজা খুলে দিলেন।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহ ‘মাজমুউল ফাতাওয়া’ গ্রন্থে (২১/১০৬) বলেন: ‘ফোটা ফোটা (পেশাব) বের করে পুরুষাঙ্গ পরীক্ষা করা ও এ ধরনের যাবতীয় কাজ বিদাত। মুসলিম উম্মাহর ইমামদের কাছে এগুলো ওয়াজিব নয়, মুস্তাহাবও নয়। বরং বিশুদ্ধ মত অনুসারে পুরুষাঙ্গ নাড়াচাড়া করাও দেয়া বিদাত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বিধান প্রদান করেননি।

অনুরূপভাবে টিপেটিপে পেশাব বের করাও বিদাত। এর বৈধতা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদান করেননি। এ সংক্রান্ত হাদীসটি দুর্বল, যার কোনো ভিত্তি নেই। পেশাব স্বাভাবিকভাবেই বের হয়। পেশাব শেষ হলে স্বাভাবিকভাবে এর প্রবাহ থেমে যায়। এর তুলনা করা যায় ওলানের সাথে। ওলানকে ছেড়ে দিলে দুধ শুকিয়ে যাবে। আর দোহালে দুধ বের হবে।

মানুষ যত বার তার পুরুষাঙ্গ খুলবে, ততবার এর থেকে পেশাব বের হতে থাকবে। সে এটা বর্জন করলে কিছু বের হবে না। কখনও তার কাছে মনে হতে পারে কিছু বের হয়েছে, এটি ওয়াসওয়াসা।

কখনও কেউ তার পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগে কিছুটা শীতলতা অনুভব করে মনে করতে পারেন যে, যে কিছু বের হয়েছে; অথচ কোনো কিছু বের হয়নি।

পেশাব মূত্রনালির অগ্রভাগে সঞ্চিত ও স্থিত থাকে, ফোঁটায় ফোঁটায় বেরিয়ে পড়ে না। পুরুষাঙ্গ, গোপনাঙ্গ বা ছিদ্রটি কোনো পাথর, আঙুল বা অন্য কিছু দিয়ে নিঙড়ানো হলে সিক্ততা বেরিয়ে আসে। এটা করাও বিদাত। স্থিত এই পেশাব পাথর বা আঙুল বা অন্য কোনো কিছু দিয়ে বের করার প্রয়োজন নেই, যে ব্যাপারে সকল আলেম একমত। বরং যতবার বের করা হবে ততবার নতুন কিছু বের হবে। কারণ এটি সর্বদা চুইয়ে পড়ে। পাথর দিয়ে শৌচকার্য করাই যথেষ্ট, পানি দিয়ে পুরুষাঙ্গ ধৌত করা লাগে না। যিনি শৌচকার্য করছেন তার জন্য পুরুষাঙ্গে পানি ছিটিয়ে দেওয়া মুস্তাহাব। যখন তিনি সিক্ততা অনুভব করবেন তখন তিনি বলবেন যে, এটি ঐ (ছিটিয়ে দেওয়া) পানি থেকে এসেছে।’[সমাপ্ত]

দুই:

পুরুষাঙ্গ পবিত্র করার পর পুরুষাঙ্গের ওপর যে পানি থেকে যায় সেটি পবিত্র। কারণ নাপাকিকে পবিত্র করার পর নাপাকি থেকে বিচ্ছিন্ন পানি পবিত্র।

তিন:

শৌচকার্য করার পর আপনার করণীয় হলো আভ্যন্তরীণ পোশাকে পানি ছিটিয়ে দেওয়া। এরপর কোনো সিক্ততা পেলে তখন সেটাকে ঐ পানি হিসেবে ধরে নিবেন।

ইবনে মাজাহ (৪৬৪) বর্ণনা করেন: জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অযু করে তাঁর লজ্জাস্থানে পানি ছিটিয়ে দিয়েছেন।”[শাইখ আলবানী তার সহীহু ইবনে মাজাহ গ্রন্থে হাদীসটিকে সহিহ বলেছেন]

ইবনে কুদামা রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “ওয়াসওয়াসা দূর করার জন্য পুরুষাঙ্গ ও পায়জামায় পানি ছিটিয়ে দেওয়া মুস্তাহাব।

হাম্বল বলেন: আমি আহমদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম: আমি অযু করতে গিয়ে নাপাকি থেকে পবিত্র হই। কিন্তু আমার মনে হয় যে, আমি আবার নাপাক হয়ে গিয়েছি। তিনি বললেন: তুমি যখন অযু করতে চাইবে তখন নাপাকি থেকে পবিত্র হবে এবং এক অঞ্জলি পানি নিয়ে তোমার পুরুষাঙ্গের ওপর ছিটিয়ে দিবে। এই ভাবনার দিকে ভ্রুক্ষেপ করবে না। ইনশা আল্লাহ এটি চলে যাবে।”[সমাপ্ত][আল-মুগনী (১/১১৫)]

আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা (৪/১২৫) গ্রন্থে রয়েছে: “হানাফী, শাফেয়ী ও হাম্বলীরা বলেন: ব্যক্তি পানি দিয়ে শৌচকার্য সম্পাদন করার পর তার জন্য মুস্তাহাব নিজ পুরুষাঙ্গ ও পায়জামায় কিছু পানি ছিটিয়ে দেওয়া; যাতে ওয়াসওয়াসা বন্ধ করা যায়। এমনকি তার মনে যদি কোন সন্দেহের উদ্রেক হয়, তাহলে সিক্ততাকে ঐ ছিটিয়ে দেওয়া পানি হিসেবে গণ্য করবে যতক্ষণ না এর বিপরীত কিছু নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়।”[সমাপ্ত]

আপনার প্রশ্ন থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে আপনি ‘ওয়াসওয়াসা’ রোগে আক্রান্ত। মহান আল্লাহ আপনাকে স্বীয় অনুগ্রহ দিয়ে এর থেকে সুস্থতা দান করুন। আপনি সাধ্যমত এই ওয়াসওয়াসা থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করুন এবং আল্লাহর কাছে এর থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করুন। আমরা আপনাকে উপদেশ দিব যেন আপনি একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখান। কেননা ওয়াসওয়াসা অন্যান্য রোগের মতই একটি রোগ। আপনি যদি এর চিকিৎসায় চিকিৎসা শাস্ত্রের পাশাপাশি দোয়া-রুকইয়া এবং আচরণগত চিকিৎসা গ্রহণ করেন, তাহলে সেটি আপনার জন্য উত্তম এবং এই রোগ থেকে আপনার সুস্থতার জন্য অধিক আশাপ্রদ, ইন শা আল্লাহ।

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব