আলহামদু লিল্লাহ।.
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন: আরাফার ময়দান থেকে মুযদালিফায় আসার ক্ষেত্রে যে ভুলগুলো ঘটে থাকে এগুলোর মধ্যে রয়েছে:
এক:
আরাফা থেকে মুযদালিফাতে আসার সময় হাজীসাহেবগণ একে অপরের সাথে ধাক্কাধাক্কি করা। অতি দ্রুত চলা; যার ফলে কখনও কখনও গাড়ীর সাথে এক্সিডেন্ট হয়। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফার ময়দান থেকে ধীরস্থিরে রওয়ানা হয়েছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রওয়ানা হওয়ার পর তাঁর উটনী ‘কাসওয়া’ এর লাগাম টেনে ধরে তাঁর সম্মানিত হাত দিয়ে বলেছেন: ওহে ভাইসব! ধীরে চলুন, ধীরে চলুন। তবে তা সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখনি খালি জায়গা পেয়েছেন দ্রুত চলেছেন। যখন কোন টিলা পার হতেন তখন উটের লাগাম ঢিল করে দিতেন, যাতে করে উটনীটি উপরে উঠতে পারে। অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চলার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখতেন। কিন্তু, যখন বিষয়টি এমন হবে যে, জোরে চলা উত্তম; নাকি আস্তে চলা; সেক্ষেত্রে আস্তে চলাই উত্তম।
দুই:
কিছু কিছু মানুষ মুযদালিফাতে না পৌঁছেই অবস্থান গ্রহণ করেন। বিশেষতঃ যারা হেঁটে হেঁটে যান তারা। হাঁটতে হাঁটতে তারা ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে অক্ষম হয়ে পড়েন। যার ফলে তারা মুযদালিফাতে পৌঁছার আগেই অবস্থান গ্রহণ করেন। ফজরের নামায আদায় করা পর্যন্ত তারা সেখানে থেকে যান। এরপর তারা সেখান থেকে মীনার উদ্দেশ্যে গমন করেন। যে ব্যক্তি এমনটি করেছে তার মুযদালিফাতে রাত্রি যাপন ছুটে গেছে। এটি খুবই জঘন্য বিষয়। কারণ মুযদালিফাতে রাত্রি যাপন কোন কোন আলেমের মতে, হজ্জের একটি রুকন। জমহুর আলেমের মতে, এটি হজ্জের একটি ওয়াজিব। আর কোন কোন আলেমের মতে, এটি সুন্নত। সঠিক অভিমত হচ্ছে- এটি ওয়াজিব এবং হাজীসাহেবের কর্তব্য হচ্ছে- মুযদালিফাতে রাত্রি যাপন করা এবং শরিয়তপ্রণেতা যে নির্দিষ্ট সময়ের আগে মুযদালিফা ত্যাগ করার অনুমতি দেয়নি সে সময়ের আগে মুযদালিফা ত্যাগ না করা। অচিরেই সে আলোচনা আসবে।
তিন:
কিছু কিছু মানুষ মুযদালিফাতে পৌঁছার আগে পথিমধ্যে সাধারণ অবস্থার মত মাগরিব ও এশার নামায আদায় করে ফেলেন; এটি সুন্নতের বরখেলাফ। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন পথিমধ্যে নামলেন এবং প্রস্রাব করে ওযু করলেন তখন উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ্? তখন তিনি বললেন: নামায সামনে।”[সহিহ বুখারী (১৬৬৯) ও সহিহ মুসলিম (১২৮০)] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবেই থাকলেন। মুযদালিফাতে পৌঁছে তিনি নামায আদায় করলেন। এশার নামাযের ওয়াক্ত প্রবেশ করার পর তিনি মুযদালিফাতে পৌঁছেছেন। তিনি মাগরিব ও এশার নামায জময়ে-তাখির (বিলম্বে একত্রীকরণ) করে আদায় করেছেন।
চার:
কিছু কিছু মানুষ এশার নামাযের ওয়াক্ত পার হয়ে গেলেও মুযদালিফাতে না পৌঁছার কারণে মাগরিব-এশার নামায আদায় করেন না। এটি জায়েয নয়; বরং হারাম ও কবিরা গুনাহ। কারণ কুরআন-হাদিসের দলিলের ভিত্তিতে, নামাযকে তার নির্দিষ্ট সময় থেকে বিলম্বে আদায় করা হারাম। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “নির্ধারিত সময়ে নামায আদায় করা মুমিনদের উপর অবশ্য কর্তব্য।”[সূরা নিসা, আয়াত: ১০৩] নামাযের এ সময়সীমা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সীমারেখা লঙ্ঘন করে সে নিজের উপর অত্যাচার করে।”[সূরা ত্বালাক, আয়াত: ১] আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন: “আর যারা আল্লাহ্র সীমারেখা লঙ্ঘন করে তারাই যালিম।”[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২২৯] অতএব, হাজীসাহেব যদি এই আশংকা করেন যে, মুযদালিফাতে পৌঁছার আগেই এশার নামাযের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাবে সেক্ষেত্রে তাঁর উপর আবশ্যক হচ্ছে- নামায আদায় করে নেয়া। এমনকি মুযদালিফাতে না পৌঁছলেও; তিনি যে অবস্থায় আছেন সে অবস্থাতেই নামায আদায় করে নিবেন। যদি তিনি পদব্রজী হন তাহলে দাঁড়িয়ে কিয়াম ও রুক-সিজদাসহ নামায আদায় করে নিবেন। আর যদি আরোহী হন এবং নামা সম্ভবপর না হয় তাহলে গাড়ীতে থেকে হলেও নামায আদায় করে নিবেন। এর দলিল হচ্ছে আল্লাহ্ তাআলার বাণী: “তোমরা আল্লাহ্কে সাধ্যানুযায়ী ভয় কর।”[সূরা তাগাবুন, আয়াত: ১৬] যদিও গাড়ী থেকে নামতে না পারার সম্ভাবনাটি একেবারেই দূরবর্তী। কারণ প্রত্যেক মানুষই রাস্তার ডানপার্শ্বে বা বামপার্শ্বে নেমে নামায পড়তে পারেন।
মোটকথা: কারো জন্য মাগরিব ও এশার নামায আদায়ে এত বিলম্ব করা জায়েয হবে না যাতে করে এশার ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায়– এই যুক্তিতে যে, তিনি সুন্নাহ্র অনুসরণ করতে চান এবং মুযদালিফাতে না পৌঁছে নামায পড়বেন না। কেননা এত দেরী করাটা সুন্নাহ্র বরখেলাফ। যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেরী করেছেন ঠিক; তবে তিনি ওয়াক্তের মধ্যে নামায আদায় করেছেন।
পাঁচ:
কিছু কিছু হাজীসাহেব ফজরের নামাযের ওয়াক্ত হওয়ার আগেই নামায পড়ে ফেলেন। নামায পড়েই তারা রওয়ানা হয়ে যান। এটি মারাত্মক ভুল। কারণ ওয়াক্ত হওয়ার আগে নামায আদায় করলে নামায কবুল হবে না। বরং তা হারাম কাজ। কেননা সেটি আল্লাহ্র সীমারেখার লঙ্ঘন। যেহেতু নামাযের ওয়াক্ত নির্ধারিত। শরিয়ত ওয়াক্তের শুরু ও শেষ নির্ধারণ করে দিয়েছে। অতএব, কারো জন্য ওয়াক্ত হওয়ার আগে নামায আদায় করা জায়েয নয়।
এ কারণে হাজীসাহেবের উপর আবশ্যক হল এ বিষয়ে সাবধান থাকা এবং ফজরের ওয়াক্ত হওয়া নিশ্চিত হওয়ার পর বা প্রবল ধারণা হওয়ার পর ফজরের নামায আদায় করা। এটা ঠিক যে, মুযদালিফাতে ফজরের নামায আগে আগে আদায় করা বাঞ্ছনীয়। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগে আগে আদায় করেছেন। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, ওয়াক্ত হওয়ার আগে নামায পড়া হবে। সুতরাং এ ব্যাপারে হাজীসাহেবগণ সতর্ক থাকুন।
ছয়:
কিছু কিছু হাজীসাহেব মুযদালিফাতে কিছুমাত্র সময়ও অবস্থান না করে মুযদালিফা ত্যাগ করেন। আপনি দেখবেন, তিনি চলার মধ্যেই আছেন এবং অতিক্রম করে যাচ্ছেন; থামছেন না। তিনি বলেন: অতিক্রম করে যাওয়াই তো যথেষ্ট। এটি মহা ভুল। কারণ অতিক্রম করা যথেষ্ট নয়। বরং সুন্নাহ্ প্রমাণ করে যে, হাজীসাহেব মুযদালিফাতে ফজরের নামায পড়া পর্যন্ত অব্স্থান করবেন। এরপর আল-মাশআরুল হারামের নিকটে অবস্থান করে খুব ফর্সা হওয়া (খুব ফর্সা হওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- সূর্যোদয়ের পূর্বে দিনের আলো ছড়িয়ে পড়া) পর্যন্ত আল্লাহ্র কাছে দোয়া করবেন। এরপর মীনার উদ্দেশ্যে মুযদালিফা ত্যাগ করবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরিবারের মধ্যে যারা শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন তাদেরকে রাত থাকতেই মুযদালিফা ত্যাগ করার অনুমতি দিয়েছেন। আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ) চন্দ্র অস্ত যাওয়ার অপেক্ষায় থাকতেন। চন্দ্র অস্ত গেলে তিনি মুযদালিফা হতে মীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতেন।
(ওজরগ্রস্তদের) আগে চলে যাওয়ার সময়টা চন্দ্র অস্ত যাওয়ার সাথে নির্দিষ্ট করা বাঞ্ছনীয়। কেননা এটা একজন সাহাবীর আমল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরিবারের যারা দুর্বল ছিলেন তাদেরকে রাতে মুযদালিফা ত্যাগ করার অনুমতি দিয়েছেন; কিন্তু রাতের কখন তারা মুযদালিফা ত্যাগ করবে সেটা তিনি স্পষ্ট করেননি। এ সাহাবীর এ আমল সে অস্পষ্টতাকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে। তাই দুর্বল ও অন্য যাদের জন্য মানুষের ভিড়ে গমন করা কষ্টকর তাদের মুযদালিফা ত্যাগ করার জন্য এ সময়টিকে তথা চন্দ্র অস্ত যাওয়াকে নির্দিষ্ট করা বাঞ্ছনীয়। মাসের ১০ তারিখ রাতের চন্দ্র নিশ্চিতভাবে মধ্যরাতের পরেই অস্ত যাবে এবং তখন রাতের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ কেটে যাবে।
সাত:
কিছু কিছু মানুষ মুযদালিফার রাত নামায আদায়, কুরআন তেলাওয়াত ও যিকিরের মাধ্যমে কাটায়। এটি সুন্নাহ বিরোধী। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ রাতে এ ধরণের কোন ইবাদত করেননি। বরং সহিহ মুসলিমে জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এশার নামায আদায় করার পর ফজর হওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম করেছেন। ফজর হওয়ার পর তিনি ফজরের নামায আদায় করেছেন। এ হাদিস প্রমাণ করে যে, ঐ রাতে কোন তাহাজ্জুদের নামায, ইবাদত বন্দেগী, তাসবিহ, যিকির-আযকার বা কুরআন তেলাওয়াত নেই।
আট:
কিছু কিছু হাজীসাহেব সূর্যোদয় পর্যন্ত মুযদালিফাতে অবস্থান করেন এবং মুযদালিফাতে ইশরাকের নামায আদায় করেন; এরপর রওয়ানা হন। এটিও ভুল। কেননা তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের খেলাফ এবং মুশরিকদের আদর্শের মোতাবেক। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুযদালিফা থেকে আকাশ ভালভাবে ফর্সা হওয়ার পর সূর্যোদয়ের আগেই রওয়ানা হয়েছেন। আর মুশরিকেরা সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা করত।
অতএব, যে ব্যক্তি সূর্যোদয় পর্যন্ত সময় আল্লাহ্র ইবাদত হিসেবে অপেক্ষা করবে সেটা মুশরিকদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যাবে এবং সাইয়্যেদুল মুরসালিন এর সুন্নতের খেলাফ হবে।