আলহামদু লিল্লাহ।.
প্রিয় ভাই, আল্লাহ্ যে আপনাকে তাওবা করার ও দ্বীন মেনে চলার তাওফিক দিয়েছেন আপনার উচিত মৃত্যু এসে পড়ার আগে আপনার প্রতি আল্লাহ্র নেয়ামতকে মূল্যায়ন করা। তখন আপনি এই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করাকে বড় কিছু ভাববেন। এর ফলে আপনি আল্লাহ্র ইবাদতে আরও বেশি শ্রম দিতে পারবেন।
মুগিরা বিন শু’বা (রাঃ) বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এত বেশি রাতের নামায পড়তেন যে, তাঁর পাদ্বয় ফুলে যেত। তখন তাঁকে বলা হল: আল্লাহ্ আপনার পূর্বের ও পরের সব গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। তখন তিনি বললেন: আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না?!
তাহলে কিভাবে আপনি নিজের ক্ষেত্রে ভালো কিছু পেয়ে মন্দ কিছু করতে সন্তুষ্ট হতে পারেন এবং কিভাবে কিছু পথ অতিক্রম করার পর পুনরায় রাস্তার শুরুতে ফিরে যেতে পারেন। বরঞ্চ আপনি যদি পূর্বের সেই সরল পথে ফিরে যেতেন। আল্লাহ্ আপনাকে হেদায়েতের নেয়ামত দেয়ার পরে আপনি বক্র পথে হাঁটছেন। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন ঘটা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। আব্দুল্লাহ্ বিন সারজিস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সফর করতেন তখন তিনি আশ্রয় প্রার্থনা করতেন সফরের অযাচিত কষ্ট-ক্লেশ থেকে, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন থেকে, হেদায়েতের পর পশ্চাদপসরণ থেকে, মজলুমের বদদোয়া থেকে, পরিবার ও সম্পদে খারাপ কিছু দেখা থেকে।”[সহিহ মুসলিম (১৩৪৩)]
নাসাঈ (৫৪৯৮) ও অন্যদের রেওয়ায়েতে এসেছে: “উন্নতির পর অবনতি” থেকে।
আল্লাহ্ তাআলা তাঁর পবিত্র কিতাবে অবস্থার অবনতি, নির্মাণের পর ধ্বংস করে ফেলা ও হেদায়তের পথ গ্রহণ করার পর পথচ্যুত হওয়ার একটি উপমা পেশ করেছেন। সেই উপমার মাধ্যমে তিনি এমন ব্যক্তির খারাপ অবস্থা, তার নির্বাচনের কদর্যতা তুলে ধরেছেন এবং বান্দাদেরকে এ ধরণের বোকাদের কর্ম থেকে সাবধান করেছেন। তিনি বলেন: “আর তোমরা আল্লাহ্র অঙ্গীকার পূর্ণ কর যখন অঙ্গীকার কর। তোমরা আল্লাহ্কে তোমাদের জামিনদার করে শপথ দৃঢ় করার পর তা ভঙ্গ করো না। নিশ্চয় তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ্ তা জানেন। তোমরা সে নারীর মত হয়ো না, যে তার বুননকে মজবুত করে পাকানোর পর সেটাকে ছিন্নভিন্ন করে নষ্ট করে দিত; যে তোমরা তোমাদের শপথকে ধোঁকাবাজির জন্য ব্যবহার করবে, যাতে করে একদল অন্যদলের চেয়ে বেশী হও। আল্লাহ্ তো এটা দিয়ে শুধু তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন। আর অবশ্যই তিনি কিয়ামতের দিন সেটা তোমাদের কাছে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিবেন যা নিয়ে তোমরা মতভেদ করতে।[সূরা নাহল, আয়াত: ৯১-৯২]
শাইখ সা’দী (রহঃ) বলেন: এটি প্রভুর সাথে বান্দার কৃত সকল ইবাদত, মানত ও পাকাপোক্ক শপথসমূহের অঙ্গীকারকে অন্তর্ভুক্ত করে; যদি সে শপথসমূহ পূর্ণ করা নেককাজ হয়। অনুরূপভাবে এক বান্দা ও অপর বান্দার মাঝে সম্পাদিত বিষয়গুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করে; যেমন: দুই পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিগুলো।
“তোমরা হয়ো না”: শপথ ভঙ্গের ক্ষেত্রে নিকৃষ্ট ও কদর্য উদাহরণ হয়ো না; যে উদাহরণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বোকামির প্রকৃষ্ট প্রমাণ বহন করে। উদাহরণটি হলো: সেই নারীর যে নারী মজবুতভাবে বুনন করে, বুননকে পাকানোর পর ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হওয়ার পর সেটাকে খুলে ফেলে ও ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। এতে করে সেই নারী একবার বুনন করতে গিয়ে ক্লান্ত হলো, আবার খুলতে গিয়ে ক্লান্ত হলো। এর থেকে সেই নারী ব্যর্থতা, কষ্ট, বিবেকহীনতা ও চিন্তার দৈন্যতা ছাড়া আর কোন উপকার পেল না। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি অঙ্গীকারকে ভঙ্গ করে সে অন্যায়কারী, মূর্খ, নির্বোধ, দ্বীনদারি ও ব্যক্তিত্বের অভাবগ্রস্ত।[পৃষ্ঠা-৪৪৭ থেকে সমাপ্ত]
সুতরাং আপনি যে অবস্থার উপর আছেন এর থেকে অবিলম্বে দ্রুত তাওবা করুন। কারণ যে গুনাহগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ্র অবাধ্যতা করা হয় সেগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জঘন্য হলো নামায ত্যাগ করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায ত্যাগ করাকে কুফর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন: “আমাদের ও তাদের মধ্যে চুক্তি হলো নামাযের। সুতরাং যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করল, সে কুফরি করল।”[সুনানে তিরমিযি (২৫৪৫), মুসনাদে আহমাদ ও অন্যান্য; আলবানী হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]
অদ্ভুত বিষয় হলো প্রশ্নকারী ভাই কিভাবে বলছেন যে: আমি চেষ্টা করেছি যাতে কোন পাপে লিপ্ত না হই; এরপর তিনি উল্লেখ করেন যে, তিনি অনেক নামায নষ্ট করেছেন। সুতরাং পাপের ব্যাপারে উনার দৃষ্টিভঙ্গিটা কী?!!
নিঃসন্দেহে আপনি যত গুনাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন এর মধ্যে নামায ত্যাগ করা সর্বাধিক জঘন্য ও সর্বাধিক বিপদজনক গুনাহ; কেবল আল্লাহ্র সাথে শির্ক করা ছাড়া।
সুতরাং আর দেরী নয় অবিলম্বে তাওবা করুন। পূর্বে যা ঘটে গেছে সেটার জন্য অনুতপ্ত হোন। সেই সময় এসে পড়ার পূর্বে যে সময়ে মানুষ অনুতপ্ত হবে; কিন্তু তার অনুতপ্ততা কোন কাজে আসে না।
আপনি বলেছেন: “নামাযের ক্ষেত্রে আপনার একটি গিঁট (জটিলতা) আছে। আপনি অনুভব করেন যে, এই জটিলতা থেকে আপনি কখনও সুস্থ হবেন না”: এটি শয়তানের ধোঁকা, তার প্রবঞ্চনা ও ভীতিসঞ্চার করণ। আপনি নিজেই নিজের বিরুদ্ধে শত্রুকে সহযোগিতা করছেন। আপনি শয়তানকে আপনার অন্তরে দুঃশ্চিন্তা, অলসতা, নেককাজে হীন মনোবল ও ভঙ্গুর ইচ্ছার গিঁট তৈরীর সুযোগ দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহ্র আনুগত্য, নিয়মিত ওযু করা ও আগে আগে মসজিদে চলে যাওয়ার মাধ্যমে এই গিঁটটি অপসারণ করুন।
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের কেউ যখন নিদ্রা যায় তখন শয়তান তার মাথার পিছনের অংশে তিনটি গিঁট দেয়। প্রত্যেক গিঁটের সময় এ কথা বলে কুমন্ত্রণা দেয় যে: ‘এখনো দীর্ঘ রাত বাকী; অতএব ঘুমিয়ে থাক’। যদি সে ব্যক্তি জেগে উঠে এবং আল্লাহর যিকির করে তখন একটি গিঁট খুলে যায়। তারপর সে যদি ওজু করে তখন দ্বিতীয় গিঁটটি খুলে যায়। আর যদি সে নামায আদায় করে তখন সবগুলো গিঁট খুলে যায়। যার ফলে এই ব্যক্তি ভালো মনে কর্মচঞ্চলতা নিয়ে সকালে ওঠে। অন্যথায় কলুষিত মনে অলসতা নিয়ে সকালে ওঠে।”[সহিহ বুখারী (৩২৬৯) ও সহিহ মুসলিম (৭৭৬)]
ইবনে আব্দুল বার্র (রহঃ) বলেন: “এই হাদিস থেকে জানা যায় যে, শয়তান মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে, তার অলসতা বাড়িয়ে দেয়। শয়তান এটি করে তার চেষ্টা দিয়ে এবং শয়তানকে কুমন্ত্রণা দেয়া, প্ররোচিত করা, পথভ্রষ্ট করা, বাতিলকে সুশোভিত করা ও বাতিল সম্পাদনে সহযোগিতা করার যে শক্তি দেয়া হয়েছে সেটাকে ব্যবহার করে। তবে আল্লাহ্র একনিষ্ঠ বান্দাদেরকে পারে না।
এই হাদিসে প্রমাণ রয়েছে যে, আল্লাহ্র যিকিরের মাধ্যমে শয়তানকে তাড়ানো যায়। অনুরূপভাবে ওযু ও নামাযের মাধ্যমেও তাকে তাড়ানো যায়...।”[আত্-তামহীদ (১৯/৪৫) থেকে সমাপ্ত]
ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) বলেন: “কোন সন্দেহ নেই যে, নামায আদায়ের মধ্যে শরীরের সুস্থতার সংরক্ষণ, খাদ্যমিশ্রণ ও বর্জ্যগুলোকে গলানো যায়— যা ব্যক্তির জন্য সর্বাধিক উপকারী। এছাড়া নামাযের মধ্যে ঈমানের সুস্থতা এবং দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ তো আছেই।
অনুরূপভাবে রাত্রিকালীন নামায স্বাস্থ্য সুরক্ষার সর্বাধিক উপকারী উপায় এবং অনেক দূরারোগ্য রোগ প্রতিহত করার মাধ্যম এবং শরীর, রূহ ও অন্তরকে চাঙ্গা রাখার কার্যকরী পদক্ষেপ; যেমনটি উদ্ধৃত হয়েছে সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে”। এরপর তিনি হাদিসটি উল্লেখ করেছেন।[যাদুল মাআদ (৪/২২৫)]
সুতরাং ওহে আল্লাহ্র বান্দা! আপনার শত্রুর সামনে দুর্বল হবেন না। শত্রুকে আপনার উপর আধিপত্য করার সুযোগ দিবেন না। আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চান, অক্ষম হবেন না— যেমনটি নির্দেশ দিয়েছেন আপনার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জেনে রাখুন: “শয়তানের কৌশল দুর্বল”।[সূরা নিসা, আয়াত: ৭৬] জেনে রাখুন, পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায পড়া সহজ একটি বিষয় এবং এ নামাযগুলো নিয়মিত আদায় করতে একজন মুসলিমের তেমন কোন কষ্ট হয় না।
আর আপনি মনোবল হারিয়ে ফেলার যে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন; হতে পারে এর কারণ আপনি যাদের সাথে উঠাবসা করেন তারা। তাই সাধ্যানুযায়ী যিকির ও ইলমের মজলিসগুলোতে হাযির হওয়ার চেষ্টা করুন। ভালো মানুষদের সাথে সঙ্গ দিন। কেননা মানুষ ইবাদত বন্দেগী পালনে যখন অনুকরণ করার মত কাউকে দেখে এবং এক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করার মত কাউকে পায় তখন তার কাছে সেটি সহজ হয়ে যায়। মানুষকে এমন কিছু পরিস্থিতির শিকার হতেই হয় যাতে ভালো কাজের প্রতি তার উদ্দীপনা ও আগ্রহ বাড়ে। আবার এমন কিছু পরিস্থিতির শিকার হতে হয় যাতে তার সেই আগ্রহ কমে যায়। কিন্তু সেই পরিস্থিতি ফরয ইবাদত বর্জন করা কিংবা হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার অবস্থায় পর্যবসিত হওয়া জায়েয নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “নিশ্চয় প্রত্যেক আমলের একটি উদ্দীপনা থাকে এবং প্রত্যেক উদ্দীপনার একটি নিস্তেজতা থাকে। যার উদ্দীপনা হবে আমার সু্ন্নাহর দিকে সে সফলকাম। আর যার নিস্তেজতা হবে অন্য কোন দিকে সে ধ্বংস হল।”[মুসনাদে আহমাদ (৬৭২৫), আলবানী ‘সহিহুল জামে’ গ্রন্থে (২১৫১) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]
এ কারণে প্রিয় ভাই, আপনার জন্য উপদেশ হলো: আপনি আপনার জন্য একটি স্থিতিশীল আমলসূচী করে নিন। এই আমলসূচীতে ঘাটতি হতে দিবেন না। এই আমলসূচীতে ফরয আমল ও তাগিদপূর্ণ নফল আমলগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। যদি কোন কোন সময় কিছু বেশি আমল করতে পারেন তাহলে সেটা ভালোর উপরে ভালো। আর যদি কিছুটা কমও করেন তাহলে যেন ফরয ইবাদতে ঘাটতি না হয়।
আর আপনার যে নামাযগুলো ছুটে গেছে সেগুলো যদি ঘুমের কারণে ছুটে গিয়ে থাকে তাহলে এর জন্য আপনার কোন গুনাহ হবে না। তবে এর কাযা পালন করা আপনার উপর আবশ্যক। আর যে নামাযগুলো কোন ওজর ছাড়া অর্থাৎ অলসতাবশতঃ ছুটে গেছে; সেগুলোর জন্য আপনার উপর তাওবা করা আবশ্যক। সেগুলোর ক্ষেত্রে কাযা পালন কোন উপকারে আসবে না। আপনার উপর আবশ্যক হলো বেশি বেশি নফল ইবাদত করা ও ইস্তিগফার করা। আশা করা যায় আল্লাহ্ আপনাকে মাফ করে দিবেন।
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।