বৃহস্পতিবার 27 জুমাদাল আউওয়াল 1446 - 28 নভেম্বর 2024
বাংলা

সাহু সিজদার কারণসমূহ

প্রশ্ন

মুসল্লীকে কখন নামাযে সাহু সিজদাহ দিতে হবে?

উত্তরের সংক্ষিপ্তসার

উত্তরের সারাংশ: নামাযে সাহু সিজদাহর কারণ তিনটি। যথা: বৃদ্ধি, কমতি ও সন্দেহ। যদি মুসল্লী কোনো ওয়াজিব ছেড়ে দেয় অথবা রাকাতের সংখ্যার ব্যাপারে সন্দেহে ভুগেন এবং সন্দেহের দুইপ্রান্তের কোনোটি তার কাছে প্রাধান্য না পায় তাহলে তাকে সালামের আগে সাহু সিজদাহ দিতে হবে। আর যদি নামাযে কোন কিছু বাড়তি করেন কিংবা সন্দেহ করেন এবং সন্দেহের প্রান্তদ্বয়ের কোন একটি তার কাছে প্রাধান্য পায় তাহলে সালামের পরে সাহু সিজদাহ দিতে হবে।

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক: সাহু সিজদার বিধিবদ্ধতা

বান্দাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ এবং এই পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের অন্যতম সৌন্দর্যের নিদর্শন হল তাদের ইবাদতে যে ঘাটতি প্রবেশ করে তা পূরণের বিধান তিনি প্রদান করেছেন, যে ঘাটতি থেকে তারা পুরোপুরি বেঁচে থাকতে পারে না। সেটা নফল ইবাদতের মাধ্যমে কিংবা ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে কিংবা অনুরূপ কিছুর মাধ্যমে।

বান্দাদের নামাযে আপতিত ঘাটতি পূরণের জন্য আল্লাহ তার বান্দাদেরকে সাহু সিজদার বিধান দিয়েছেন। তবে এই বিধান আরোপ করা হয়েছে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের ক্ষতিপূরণের জন্য। সকল কিছুর ক্ষতি সাহু সিজদা পূরণ করবে না কিংবা সব কিছুর জন্য সাহু সিজদা দেয়ার বিধান নেই।

দুই: সাহু সিজদার কারণসমূহ

সাহু সিজদার কারণসমূহের ব্যাপারে শাইখ ইবনে উছাইমীনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি উত্তর দেন:

সাকুল্যে নামাযে সাহু সিজদার কারণ তিনটি:

১. বৃদ্ধি

২. কমতি

৩. সন্দেহ

বৃদ্ধির উদাহরণ হলো: কেউ একটা রুকু, একটা সিজদাহ, একটা দাঁড়ানো বা একটা বসা বৃদ্ধি করা।

কমতির উদাহরণ হলো: কেউ নামাযের কোন একটা রোকন বা নামাযের কোন একটা ওয়াজিব কম করা।

সন্দেহের উদাহরণ হলো: কোন ব্যক্তি নামাযের সংখ্যা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যাওয়া; যেমন সে কি তিন রাকাত পড়েছে; নাকি চার রাকাত।

তিন: নামাযে বৃদ্ধির কিছু রূপ

নামাযে একজন মানুষ যদি একটা রুকু, একটা সিজদা, একটা দাঁড়ানো বা একটা বসা ইচ্ছা করে বৃদ্ধি করে— তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে। কারণ সে নামাযে কিছু বৃদ্ধি করার অর্থ হলো আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতির ভিন্ন পদ্ধতিতে নামায পড়া। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যা আমাদের নির্দেশনার ভিত্তিতে নয় তা প্রত্যাখ্যাত।”[সহীহ মুসলিম (১৭১৮)]

আর যদি ভুলবশতঃ বৃদ্ধি করে তাহলে নামায বাতিল হবে না। কিন্তু সালামের পর সাহু সিজদা দিতে হবে। এর পক্ষে দলীল হলো আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস; যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিকেলের দুই নামাযের কোনো এক নামাযে, সেটা যোহর কিংবা আসর, দুই রাকাত পড়ে সালাম ফিরিয়ে ফেলেন। তারা (সাহাবীরা) যখন বিষয়টি তাঁকে জানাল তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাকি নামায পড়ে সালাম ফেরালেন। সালামের পর তিনি দুটি সিজদাহ দিলেন।[হাদীসটি বুখারী (৪৮২) ও মুসলিম (৫৭৩) বর্ণনা করেছেন]।

আরো একটি দলীল হল ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস, তিনি বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে যোহরের নামায পাঁচ রাকাত পড়ালেন। নামায শেষে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল: ‘নামাযে কি বৃদ্ধি করা হয়েছে?’ তিনি বললেন: “এ প্রশ্ন কেন?” তারা বলল: আপনি পাঁচ রাকাত নামায পড়েছেন। তিনি তখন তার দুই পা ঘুরিয়ে কিবলামুখী হলেন এবং দুটি সিজদাহ দিলেন।[হাদীসটি বুখারী (৪০৪) ও মুসলিম (৫৭২)]

চার: নামাযে কমতির কিছু রূপ

আর কমতি হলো: যদি কেউ নামাযের কোনো একটা রোকন কমায় এক্ষেত্রে তার অবস্থা হতে পারে পরবর্তী রাকাতে ঐ রোকনের স্থানে পৌঁছানোর আগে তার স্মরণ পড়বে‌। তখন তার উপর আবশ্যক হল ঐ রোকনে ফিরে এসে সেটা থেকে পরবর্তী আমলগুলো সম্পন্ন করা।

আর যদি পরবর্তী রাকাতে ঐ রোকনের স্থানে পৌঁছার পর মনে পড়ে তাহলে দ্বিতীয় রাকাতটি আগের রোকন ত্যাগকৃত রাকাতের স্থলাভিষিক্ত হবে। আর ঐ রাকাতের বদলে অন্য একটি রাকাত পড়ে নিবে। এ দুটো অবস্থাতেই সালামের পরে তাকে সাহু সিজদাহ দিতে হবে।

এর উদাহরণ হলো: এক ব্যক্তি প্রথম রাকাতের প্রথম সিজদা দেওয়ার পর দাঁড়িয়ে গেল, আর বসল না এবং দ্বিতীয় সিজদাও দিল না। যখন ক্বেরাত শুরু করল তখন তার মনে পড়ল যে সে সিজদাহ দেয়নি এবং দুই সিজদার মাঝে বসেনি। তখন সে ফিরে গিয়ে দুই সিজদার মাঝে বসবে, তারপর (দ্বিতীয়) সিজদাহ দিবে, তারপর দাঁড়িয়ে নামাযের বাকিটুকু শেষ করবে। নামাযের সালাম ফেরানোর পর সাহু সিজদাহ দিবে।

আর যে ব্যক্তির দ্বিতীয় রাকাতে ঐ স্থানে পৌঁছানোর আগে মনে পড়েনি তার উদাহরণ হলো: সে প্রথম রাকাতে প্রথম সিজদাহ থেকে দাঁড়িয়ে গেল, দ্বিতীয় সিজদাহ দিল না এবং দুই সিজদার মাঝে বসল না। তবে দ্বিতীয় রাকাতে দুই সিজদার মাঝে বসার আগ পর্যন্ত বিষয়টা তার মনে পড়ল না। এমন অবস্থায় তার দ্বিতীয় রাকাতটাই হয়ে যাবে প্রথম রাকাত। সে নামাযে এক রাকাত বৃদ্ধি করে সালাম ফিরিয়ে তারপরে সাহু সিজদাহ দিবে।

নামাযে ওয়াজিবের কমতি: কেউ যদি একটা ওয়াজিব আদায় না করে পরবর্তী স্থানে চলে যায়, যেমন: سُبْحَانَ رَبِّيَ الأَعْلى (সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা) বলতে ভুলে যায় এবং সিজদা থেকে মাথা তুলে ফেলার আগে তার মনে না পড়ে; তাহলে সে ভুলবশতঃ নামাযের একটা ওয়াজিব ত্যাগ করল। এমতাবস্থায় সে নামায চালিয়ে যাবে এবং সালাম ফেরানোর আগে সাহু সিজদাহ দিবে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম বৈঠক ছেড়ে দেওয়ার পরও নামায চালিয়ে গিয়েছিলেন বৈঠকে ফিরে আসেননি। সালাম ফেরানোর আগে তিনি সাহু সিজদাহ দিয়েছিলেন।

পাঁচ: নামাযে সন্দেহের কিছু রূপ

সন্দেহ হলো বৃদ্ধি ও কমতির মাঝে দ্বিধা। যেমন: কেউ যদি দ্বিধায় পড়ে যায় হয় যে সে কি তিন রাকাত নামায পড়েছে; নাকি চার রাকাত। এক্ষেত্রে তার দুই অবস্থা:

হয়তো তার কাছে দুটির একটি প্রাধান্য পাবে: কমতি বা বৃদ্ধি; তাহলে তার কাছে যেটা প্রাধান্য পেয়েছে সেটার উপর ভিত্তি করে সে নামায পূর্ণ করবে এবং সালাম ফেরানোর পর সাহু সিজদাহ দিবে।

নতুবা তার কাছে দুটির কোনোটি প্রাধান্য পাবে না। তখন তার যতটুকুর উপর দৃঢ় বিশ্বাস আছে তথা কম সংখ্যা, ততটুকু ধরে নিয়ে নামায পূর্ণ করবে এবং সালাম ফেরানোর আগে সাহু সিজদাহ দিবে।

যেমন: এক লোক যোহর পড়ছিল। তার সন্দেহ হল সে কি তৃতীয় রাকাতে আছে; নাকি চতুর্থ রাকাতে? তার মনে প্রাধান্য পেল যে এটা তৃতীয় রাকাত। সে আরেক রাকাত পড়ে সালাম ফিরাবে। তারপর সাহু সিজদাহ দিবে।

আর যে ক্ষেত্রে সন্দেহের দুটো দিক সমান সেটার উদাহরণ হলো: এক লোক যোহরের নামায পড়ছিল। তার সন্দেহ হল যে সে কি তৃতীয় রাকাতে আছে; নাকি চতুর্থ রাকাতে? তৃতীয় নাকি চতুর্থ এর কোনোটি তার কাছে প্রাধান্য পেল না। এমতাবস্থায় সে একীনের উপর নির্ভর করবে। একীন হলো কমটাকে ধরা। তথা সে সেটাকে তৃতীয় রাকাত হিসেবে গণ্য করবে। তারপর আরেক রাকাত পড়বে এবং সালাম ফেরানোর আগে সাহু সিজদাহ দিবে।

ছয়: সাহু সিজদার স্থান

পূর্বোক্ত আলোচনার মাধ্যমে ফুটে উঠল যে সাহু সিজদাহ সালামের আগে দিতে হয়: যদি কোনো ওয়াজিব ত্যাগ করে অথবা রাকাত-সংখ্যা নিয়ে সন্দেহে পড়ে যায় এবং তার কাছে কোনো দিক প্রাধান্য না পায়।

আর সালামের পরে দিতে হয়: যদি সে নামাযে কোন কিছু বৃদ্ধি করে অথবা সন্দেহে পতিত হয়, তবে সন্দেহের কোন একটি দিক তার কাছে প্রাধান্য পায়।

দেখুন: [মাজমূ ফাতায়াশ শাইখ ইবনে উছাইমীন (১৪/১৪-১৬)]

আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব