আলহামদু লিল্লাহ।.
এক:
সম্পদ তখন নিয়ামত হয় যখন তা আল্লাহর সন্তুষ্টিতে নিয়োজিত করা হয় এবং আল্লাহর আনুগত্যের পথে সহায়ক হয়। আর তখন শাস্তির কারণ হয় যখন এটাকে খারাপ কাজে ব্যবহার হয়, এটি মালিককে অহংকারী ও উদ্ধত করে তোলে কিংবা তাকে আল্লাহর আনুগত্য ও যিকির থেকে বিমুখ করে।
তাই সম্পদের ফিতনা থেকে সতর্ক করা হয়েছে। কেননা সম্পদের আধিক্য প্রায়শঃ মানুষকে সীমালঙ্ঘন করায় ও ভুলিয়ে দেয়। খুব কম মানুষই সম্পদের ব্যাপারে আল্লাহর হক আদায় করে। বিপদাপদ ও খারাপ বিষয়ের মাধ্যমে যেমন পরীক্ষা করা হয় তেমনি সম্পদ ও নিয়ামতের মাধ্যমেও পরীক্ষা করা হয়— এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আমি তোমাদেরকে ভালো ও মন্দ দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি। আর আমাদের কাছেই তোমরা ফিরে যাবে।”[সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৩৫] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় করি না, কিন্তু ভয় করি তোমাদের সামনে দুনিয়া প্রশস্ত হয়ে যাওয়ার; যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের সামনেও দুনিয়া প্রশস্ত হয়ে গিয়েছিল। এরপর তোমরা দুনিয়ার পেছনে প্রতিযোগিতা করবে যেভাবে তারা প্রতিযোগিতা করেছিল। তাদেরকে দুনিয়া যেমন ধ্বংস করে দিয়েছিল, তোমাদেরকেও সেভাবে ধ্বংস করে দিবে।”[বুখারী (৪০১৫) ও মুসলিম (২৯৬১)]
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “অবশ্যই দুনিয়াটা চাকচিক্যময় সুমিষ্ট। আল্লাহ তায়ালা সেখানে তোমাদেরকে উত্তরসূরী নিযুক্ত করেছেন। তিনি দেখতে চান যে, তোমরা কীভাবে আমল করো। সুতরাং তোমরা দুনিয়াকে ভয় কর এবং নারীদেরকে ভয় কর। কেননা বনী ইসরাঈলের প্রথম ফিতনা ছিল নারীকেন্দ্রিক।”[মুসলিম (২৭৪২)]
কিন্তু আল্লাহ যাকে তৌফিক দিয়েছেন যিনি তার সম্পদ হালালভাবে উপার্জন করে যথাস্থানে ব্যয় করেছেন এবং কল্যাণ ও নেকীর কাজে ব্যয়ের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন; তার ক্ষেত্রে সম্পদ নিয়ামত। সেই ব্যক্তি মানুষের ঈর্ষার উপযুক্ততা অর্জন করেছে। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “নেককার ব্যক্তির জন্য নেক সম্পদ কতই না উত্তম!”[মুসনাদে আহমদ (১৭০৯৬); শাইখ আলবানী তার ‘সহীহুল আদাবিল মুফরাদ’ বইয়ে (২৯৯) এ হাদিসটাকে সহীহ বলেছেন] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন: “দুই প্রকারের লোক ছাড়া কারো সাথে হিংসা পোষণ করা যায় না। এক প্রকারের লোক হল: যাকে আল্লাহ অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন এবং হক পথে তা ব্যয় করার তাওফীক তাকে দিয়েছেন। আর অন্য ব্যক্তি হল যাকে আল্লাহ তায়ালা হিকমাহ বা সঠিক জ্ঞান দান করেছেন। সে তা অনুযায়ী কাজ করে এবং তা অন্যদের শিক্ষা দেয়।”[বুখারী (৭৩) ও মুসলিম (৮১৬)]
দুই:
অর্থ-সম্পদ কল্যাণের পথে ব্যয়ের অনেক রাস্তা আছে। তন্মধ্যে হলো: মসজিদ নির্মাণ, দান-সদাকা, এতীমের দায়িত্ব গ্রহণ, অসুস্থ ও অসহায় ব্যক্তিদের সাহায্য করা, পরিবার-সন্তান-আত্মীয়দের মনে আনন্দ প্রবেশ করানো, বারবার হজ্জ-উমরা করা, কুরআন হিফয ও ইলম শেখানোর প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, দুস্থদের ধার দেওয়া, ঋণগ্রস্তদের অবকাশ প্রদান, সাধারণ কল্যাণজনক প্রকল্পে ব্যয় করা যার দ্বারা গোটা উম্মতের উপকার হয়; যেমন: ভিশনারী স্যাটেলাইট চ্যানেল কিংবা সফল ও উপকারী ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠা। এগুলো ছাড়াও কল্যাণের আরো বহু রাস্তা আছে; যেগুলোর সংখ্যা আল্লাহই জানেন। ব্যয়কারীর জন্য জানা জরুরী যে তার প্রকৃত সম্পদ সেটাই যেটা সে আল্লাহর জন্য পেশ করেছে। কারণ মৃত্যুর পর সে এর প্রশংসনীয় ফল পাবে। আর যে সম্পদ সে জমিয়ে রেখেছে প্রকৃতপক্ষে সেটা তার সম্পদ নয়; বরঞ্চ তার ওয়ারিশদের। এই ভাবটি ইমাম বুখারী কর্তৃক সংকলিত (৬৪৪২) আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তির কাছে নিজের সম্পদের চেয়ে তার উত্তরাধিকারীর সম্পদ অধিক প্রিয়?” তারা সবাই জবাব দিল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার কাছে নিজের সম্পদ সর্বাধিক প্রিয় নয়।’ তখন তিনি বললেন: “নিশ্চয় মানুষের নিজের সম্পদ তা-ই যা সে (সৎ কাজে ব্যয়ের মাধ্যমে) আগে পাঠিয়েছে। আর যা সে পিছনে রেখে যাবে তা তার উত্তরাধিকারীর সম্পদ।”
তিন:
সম্পদ কীভাবে কাজে লাগাবেন ও বৃদ্ধি করবেন সেটা জানতে সম্পদের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হবে। তবে আমরা এক্ষেত্রে কিছু মূলনীতি দিতে পারব। যথা:
১- বিনিয়োগ শুরু করার আগে সেটার শরয়ি বৈধতা কিংবা বিনিয়োগের পদ্ধতির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা ও খোঁজ-খবর নেওয়া।
২- সুদী ব্যাংকে অর্থসম্পদ রাখা থেকে বেঁচে থাকা। যারা এটি বৈধতা হওয়ার পক্ষে ফতোয়া দেয় তাদের দ্বারা প্ররোচিত না হওয়া। কারণ সুদ আল্লাহর ক্রোধ অনিবার্য হওয়ার কারণ। সুদখোর ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত।
৩- সন্দেহপূর্ণ বিষয়গুলো থেকে দূরে থাকা।
৪- ব্যক্তির আপন সত্ত্বা, তার পরিবার-পরিজন ও বংশধরদের উপর হারাম সম্পদের ভয়াবহ প্রভাব জানা।
৫- ক্রমধারা অবলম্বন করা ও অল্পে তুষ্ট থাকা। ধীরসুস্থে যাচাই-বাছাই না করে দ্রুত লাভ এনে দেয় এমন কিছুতে প্রলুব্ধ না হওয়া।
৬- যে ব্যক্তির হাতে এই নিয়ামত তুলে দেয়া নিরাপদ নয় তার হাতে সমর্পণের মাধ্যমে নিয়ামতটি নষ্ট করা থেকে সতর্ক থাকা।
৭- সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ও স্বচ্ছতার উপর গুরুত্বারোপ করা এবং ধোকাবাজি ও অস্বচ্ছতা থেকে দূরে থাকা। কারণ এটা বরকতের কারণ এবং লাভ ও নেকী অর্জনের মাধ্যম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রেতা-বিক্রেতার ব্যাপারে বলেন: “যদি ক্রেতা-বিক্রেতা সত্য বলে এবং ভালোমন্দ প্রকাশ করে দেয় তাহলে তাদের লেনদেন বরকতময় হবে। আর যদি উভয়ে মিথ্যা বলে এবং দোষত্রুটি গোপন করে তাহলে এ লেনদেন থেকে বরকত উঠিয়ে নেওয়া হবে।”[বুখারী (২০৯৭), মুসলিম (১৫৩২)]
আল্লাহর কাছে আমরা প্রার্থনা করি, তিনি যেন আপনার সম্পদে বরকত দেন, আপনাকে সেটা বৃদ্ধির তৌফিক দান করেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক খাতে ব্যয় করার সুযোগ দান করেন।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।