রবিবার 20 যুলক্বদ 1446 - 18 মে 2025
বাংলা

ইসলামে ইবাদতের শর্তাবলি

প্রশ্ন

ইসলামে সঠিক ইবাদতের শর্তাবলি কী কী?

উত্তরের সংক্ষিপ্তসার

ইসলামে ইবাদতের শর্তাবলি:

১। ইবাদতটি ‘হেতুগত’ দিক থেকে শরীয়ত মোতাবেক হওয়া।

২। ইবাদতটি ‘প্রকারগত’ দিক থেকে শরীয়ত মোতাবেক হওয়া।

৩। ইবাদতটি ‘পরিমাণগত’ দিক থেকে শরীয়ত মোতাবেক হওয়া।

৪। ইবাদতটি ‘পদ্ধতিগত’ দিক থেকে শরীয়ত মোতাবেক হওয়া।

৫। ইবাদতটি ‘কালগত’ দিক থেকে শরীয়ত মোতাবেক হওয়া।

৬। ইবাদতটি ‘স্থানগত’ দিক থেকে শরীয়ত মোতাবেক হওয়া।

আলহামদু লিল্লাহ।.

ফকীহ শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন:

এক: ইবাদতটি ‘হেতুগত’ দিক থেকে শরীয়ত মোতাবেক হওয়া।

কোনো মানুষ যদি এমন ইবাদত করে যা শরীয়তে অপ্রমাণিত হেতুর উপর প্রতিষ্ঠিত তাহলে সেই ইবাদত প্রত্যাখ্যাত। এর উদাহরণ হলো: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিন উদযাপন করা। অনুরূপভাবে যারা রজবের সাতাইশ তারিখ উদযাপন করে। তারা দাবি করে এই রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আসমানে উত্থিত করা হয়েছে। এটি শরীয়তের খেলাফ এবং প্রত্যাখ্যাত।

১- কেননা সাতাইশ তারিখ রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিরাজ ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত নয়। আমাদের সামনে হাদীসের গ্রন্থসমূহ রয়েছে। সেগুলোতে এমন একটি হরফও নেই যা প্রমাণ করবে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রজব মাসের সাতাইশ তারিখ রাতে উত্থিত করা হয়েছে। আর এটি সুবিদিত যে এ বিষয়টি সংবাদশ্রেণীয়, যা সহীহ সনদ ছাড়া প্রমাণিত হয় না।

২- আর যদি প্রমাণিত হয়েও থাকে তাহলে সেই দিনে কোন ইবাদত উদ্ভাবন করা কিংবা সেই দিনে ঈদ পালন করার অধিকার কি আমাদের আছে? কক্ষনো নাই। তাই তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় এসে দেখতে পান যে আনসার সাহাবীরা দুই দিন খেলাধুলা করে, তখন তিনি বলেন: “আল্লাহ তোমাদেরকে এর চেয়ে উত্তম দুইটি দিন দিয়েছেন।” তিনি তাদেরকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার কথা উল্লেখ করলেন। এটি প্রমাণ করে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের তিন ঈদ ছাড়া অন্য যে কোনো নবসৃষ্ট ঈদ অপছন্দ করতেন। এই তিনটির মাঝে দু’টি বাৎসরিক ঈদ তথা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। আর অন্যটি সাপ্তাহিক ঈদ তথা জুমার দিন। যদি প্রমাণিত হয়েও থাকে যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রজবের সাতাইশ তারিখে মিরাজে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল (যা প্রমাণ করা অসম্ভব) তবুও আমাদের জন্য শরীয়তপ্রণেতার অনুমতি ছাড়া কোনো কিছু উদ্ভাবন করা বৈধ নয়।

আমি আপনাদেরকে যেমনটি বলেছি: বিদাত ভয়াবহ ব্যাপার। অন্তরের উপর বিদাত নিকৃষ্ট প্রভাব ফেলে। যদিও মানুষ তৎক্ষণাৎ অন্তরে নম্রতা ও কোমলতা অনুভব করে, কিন্তু পরবর্তীতে নিশ্চিতভাবে এর বিপরীতটি ঘটে। কারণ বাতিলকে নিয়ে অন্তরের আনন্দ স্থায়ী হয় না। বরং এর পরপরই ব্যথা, আফসোস ও  অনুশোচনা অনুভূত হয়। সকল বিদাতেরই ভয়াবহতা রয়েছে। কারণ এগুলো রাসূলের রিসালাতকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিদাতের দাবি হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরীয়ত পূর্ণ করে যাননি। অথচ মহান আল্লাহ বলেন: আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম। আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো: এই সমস্ত বিদাতে আক্রান্ত কিছু মানুষকে দেখা যায় তারা বিদাত বাস্তবায়নে খুবই তৎপর। অথচ তারা আরো উপকারী, সঠিক ও দরকারী বিষয়ের ব্যাপারে শিথিল।

তাই আমরা বলব: (রজবের) সাতাইশ তারিখ রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিরাজ হয়েছিল এই বিশ্বাস করে এই রাত উদযাপন করা বিদাত। কারণ এটি এমন এক হেতুর উপর প্রতিষ্ঠিত যা শরীয়তে উদ্ধৃত হয়নি।

দুই: ইবাদতটি ‘প্রকারগত’ দিক থেকে শরীয়ত মোতাবেক হওয়া।

উদাহরণস্বরূপ কোনো মানুষ ঘোড়া দিয়ে কুরবানী করা। এটি প্রকারগত ক্ষেত্রে শরীয়তের বরখেলাফ। (কারণ কুরবানী গবাদিপশু ছাড়া অন্য কোন প্রাণী দিয়ে দেয়া যায় না। গবাদি পশু হলো: উট, গরু এবং ছাগল-ভেড়া)

তিন: ইবাদতটি ‘পরিমাণগত’ দিক থেকে শরীয়ত মোতাবেক হওয়া।

যদি কোনো মানুষ বলে যে সে যোহরের নামায ছয় রাকাত পড়ে, তাহলে তার এই ইবাদত কি শরীয়ত মোতাবেক হলো? কক্ষনো নয়। কারণ পরিমাণের দিক থেকে সেটি শরীয়ত মোতাবেক হয়নি।

যদি কোনো মানুষ প্রত্যেক ফরয নামাযের পর সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ও আল্লাহু আকবর পয়ত্রিশ বার বলে, তাহলে কি সেটি সঠিক হবে?

উত্তর হলো: আমরা বলব: যদি আপনি এই সংখ্যাকে ইবাদত হিসেবে পালন করেন তাহলে আপনি ভুল করেছেন। আর যদি ইচ্ছা করেন যে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বিধিবদ্ধ করেছেন তা থেকে আপনি বৃদ্ধি করতে চান কিন্তু আপনি বিশ্বাস করেন যে বিধি মোতাবেক তেত্রিশ বার পড়তে হয়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। কারণ তখন আপনি ইবাদত হিসেবে করা থেকে বিষয়টিকে আলাদা করে দিলেন।

চার: ইবাদতটি ‘পদ্ধতিগত’ দিক থেকে শরীয়ত মোতাবেক হওয়া।

যদি কোনো মানুষ কোনো ইবাদতকে শরীয়তে বর্ণিত প্রকার, পরিমাণ ও হেতু অনুযায়ী পালন করে; কিন্তু পদ্ধতির ক্ষেত্রে শরীয়তের বরখেলাফ কিছু করে, তাহলে সে ইবাদত সঠিক হবে না। যেমন: কোনো মানুষের ছোট অপবিত্রতা ঘটায় সে অযু করল। কিন্তু সে এভাবে করল: পাদ্বয় ধৌত করল, তারপর মাথা মাসেহ করল, তারপর হাতদ্বয় ধৌত করল, তারপর মুখমণ্ডল ধৌত করল। এভাবে কি তার অযু সঠিক হবে? কক্ষনো নয়। কারণ সে পদ্ধতির ক্ষেত্রে শরীয়তের বরখেলাফ করেছে।

পাঁচ: ইবাদতটি ‘কালগত’ দিক থেকে শরীয়ত মোতাবেক হওয়া।

যেমন: কেউ যদি রমযানের রোযা শা’বান মাসে বা শাওয়াল মাসে রাখল। কিংবা কেউ সূর্য হেলে পড়ার আগে যোহরের নামায পড়ে ফেলল। কিংবা বস্তুর ছায়া এর দৈর্ঘের সমান হওয়ার পরে যোহরের নামায পড়ল। কেননা সে যদি সূর্য হেলে পড়ার আগে পড়ে তাহলে ওয়াক্ত হওয়ার আগে পড়ল। আর যদি বস্তুর ছায়া এর দৈর্ঘের সমান হওয়ার পরে পড়ে তাহলে ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পরে পড়ল। উভয় ক্ষেত্রেই তার নামায সঠিক নয়।

তাই আমরা বলব: যদি কেউ কোনো ধরনের ওজর ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে নামায না পড়ে এবং ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায় তাহলে সে যদি হাজার বারও ঐ নামায পড়ে সেটা কবুল হবে না। এখানে আমরা উক্ত বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি উল্লেখ করব, সেটি হলো: প্রত্যেক সময়ের সাথে নির্ধারিত ইবাদত যদি ব্যক্তি ওজর ছাড়া সময়ের পরে আদায় করে তাহলে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়; বরং প্রত্যাখ্যাত।

এর প্রমাণ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার হাদীস, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি এমন কোনো আমল করল যে ব্যাপারে আমাদের নির্দেশনা নেই (আমাদের শরিয়তে নেই) সেটা প্রত্যাখ্যাত।”

ছয়: ইবাদতটি ‘স্থানগত’ দিক থেকে শরীয়ত মোতাবেক হওয়া।

তাই কেউ যদি আরাফার দিনে মুযদালিফায় অবস্থান করেন তার সে অবস্থান করা সঠিক হবে না। কারণ তার ইবাদত স্থানগত ক্ষেত্রে শরীয়ত মোতাবেক হয়নি। একইভাবে যদি কোনো মানুষ তার নিজ ঘরে ইতিকাফ করে তাহলে সেটি সঠিক হবে না। কারণ ইতিকাফের স্থান হলো মসজিদ। তাই কোন নারীর জন্য নিজ ঘরে ইতিকাফ করা সঠিক নয়। কারণ এটি ইতিকাফের স্থান নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দেখতে পেলেন যে তার কিছু স্ত্রী মসজিদে তাঁবু স্থাপন করেছেন তখন তিনি তাঁবু সরিয়ে ইতিকাফ বাতিল করে দিতে বললেন। তাদেরকে ঘরে ইতিকাফ করার নির্দেশনা প্রদান করেননি। এটি প্রমাণ করে যে নারীর জন্য ঘরে ইতিকাফ করা সঠিক নয়। কেননা এটি স্থানগত দিক থেকে শরীয়তের পরিপন্থী।

ইবাদতের ক্ষেত্রে এ ছয়টি বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটা ছাড়া (নবীর) অনুসরণ বাস্তবায়িত হবে না। এ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:

১- ইবাদতের হেতু।

২- ইবাদতের প্রকার।

৩- ইবাদতের পরিমাণ।

৪- ইবাদতের পদ্ধতি।

৫- ইবাদতের সময়।

৬- ইবাদতের স্থান।[সমাপ্ত]

যদি আপনি আরও বেশি তথ্য জানতে চান তাহলে 14258, 13830, 49016, 9359, 147608, 113177 প্রশ্নোত্তরগুলো পড়ুন।

আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব