কুরআন-সুন্নাহর দলিল জীনদের অস্তিত্বের প্রমাণ করেছে এবং আরও প্রমাণ করেছে যে, এই জগতে তাদেরকে সৃষ্টি করার একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। সে উদ্দেশ্যটি হচ্ছে এক আল্লাহর ইবাদত করা; তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা। আল্লাহ তা’আলা বলেন: وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ “জ্বিন ও মানুষকে আমি আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।”[সূরা যারিয়াত: ৫৬] তিনি আরো বলেন: يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِنْكُمْ يَقُصُّونَ عَلَيْكُمْ آيَاتِي “হে জীন ও মানুষের দল! তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলগণ আসেনি যারা তোমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ ব্যাখ্যাসহ বর্ণনা করত?”[সূরা আন’আম: ১৩০]
জীনদের জগত একটি স্বতন্ত্র জগত। এর বিশেষ কিছু প্রকৃতি রয়েছে। এর এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলোর মানবজাতির অগোচরে রয়েছে। তাদের ও মানুষের মাঝে সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো উভয়ের বুদ্ধিমত্তা ও অনুধাবনশক্তি আছে এবং সঠিক ও ভুল পথ বাছাই করার সক্ষমতা আছে। তাদেরকে ‘জীন’ বলে অভিহিত করা হয় কেননা তারা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন: إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ “সে ও তার দলবল তোমাদেরকে দেখতে পায়; কিন্তু তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না।”[সূরা আ‘রাফ: ২৭]
জীনদের উৎস:
আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে জীন সৃষ্টির উৎস প্রসঙ্গে বলেছেন: وَالْجَانَّ خَلَقْنَاهُ مِن قَبْلُ مِن نَّارِ السَّمُومِ “তার আগে জ্বীনকে সৃষ্টি করেছি প্রচণ্ড উষ্ণ আগুন থেকে।”[সূরা হিজর: ২৭] তিনি আরো বলেন: وَخَلَقَ الْجَانَّ مِن مَّارِجٍ مِّن نَّارٍ “আর জীনকে সৃষ্টি করেছেন ধূর্মবিহীন অগ্নিশিখা থেকে।”[সূরা আর-রহমান: ১৫]
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “ফেরেশতারা নূর থেকে সৃষ্ট, জীনরা আগুন থেকে সৃষ্ট, আর আদম আলাইহিস সালাম এমন ব্স্তু থেকে সৃষ্ট যার বর্ণনা তোমাদেরকে দেওয়া হয়েছে।”[হাদীসটি মুসলিম (৫৩১৪) বর্ণনা করেন]
জীনদের প্রকারভেদ:
আল্লাহ তাআলা জীনদেরকে নানা প্রকারে সৃষ্টি করেছেন। জীনদের মাঝে কেউ কেউ নানান রূপ ধারণ করতে পারে। যেমন: কুকুর, সাপ। কেউ কেউ ডানাবিশিষ্ট প্রবহমান বাতাস হয়ে যায়। কেউ বিশ্রাম গ্রহণ করে তারপর যাত্রা করে। আবু সা’লাবা আল-খুশানী বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “জীনরা তিন প্রকার: এক প্রকারের ডানা আছে, তারা বাতাসে উড়ে বেড়ায়। আরেক প্রকার সাপ ও কুকুরের রূপ ধারণ করে। অন্য প্রকারটি কখনও সফর করে, কখনও যাত্রা বিরতি করে।”[হাদীসটি ইমাম ত্বহাভী তার ‘মুশকিলুল আছার’ (৪/৯৫) গ্রন্থে, ত্বাবারানী ‘আল-কাবীর’ (২২/২১৪) গ্রন্থে বর্ণনা করেন। শাইখ আলবানী মিশকাত (২/১২০৬, ৪১৪৮ নং) গ্রন্থে বলেন: হাদিসটি ‘ত্বহাভী ও আবুশ শাইখ সহিহ সনদে বর্ণনা করেছেন]
জীন ও আদম সন্তান:
প্রত্যেক আদম সন্তানের সাথে একজন জীন সঙ্গী আছে। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার সাথে তার একজন জীন ও একজন ফেরেশতা সঙ্গী হিসেবে নিযুক্ত করে দেওয়া হয়নি। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন: ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার সাথেও কি?’ তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: “আমার সাথেও; তবে আল্লাহ তা’আলা আমাকে জীন শয়তানের ব্যাপারে সাহায্য করেছেন। ফলে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে। তাই সে কখনো আমাকে কল্যাণকর কাজ ছাড়া ভিন্ন কোন পরামর্শ দেয় না।”[হাদীসটি মুসলিম (২৮১৪) বর্ণনা করেন]
ইমাম নববী সহিহ মুসলিমের ব্যাখ্যা গ্রন্থে (১৭/১৭৫) বলেন: ‘সে ইসলাম গ্রহণ করেছে ... অর্থাৎ সে মুসলিম ও মুমিন হয়ে গিয়েছে। এটাই বাহ্যিক অর্থ। কাযী বলেন: জেনে রাখুন, উম্মতের সবাই এ ব্যাপারে একমত যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর শরীর, মন ও জিহ্বার ক্ষেত্রে শয়তানের প্রভাব থেকে মুক্ত। উক্ত হাদীসে সঙ্গী শয়তানের ফিতনা, ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) ও বিভ্রান্তি থেকে সতর্ক করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে সঙ্গী শয়তান আমাদের সাথেই আছে তাই আমরা যেন সাধ্যমত তার থেকে সতর্ক থাকি।’[সমাপ্ত]
তাদের শক্তি-সামর্থ্য:
আল্লাহ তাআলা জীনদেরকে এমন শক্তি-সামর্থ্য দিয়েছেন যা মানুষদেরকে তিনি দেননি। তাদের কিছু সক্ষমতার কথা আল্লাহ জানিয়েছেন। তন্মধ্যে রয়েছে: দ্রুত গমন করা। আল্লাহর নবী সুলাইমান আলাইহিস সালামের সাথে জীনদের মধ্যকার এক দৈত্য অঙ্গীকার দিয়েছিল যে ইয়েমেনের রাণীর সিংহাসন বাইতুল মাকদিসে এত দ্রুত নিয়ে আসবে যা একজন ব্যক্তির বসা থেকে দাঁড়ানোর মধ্যকার সময়ে হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
قَالَ عِفْرِيتٌ مِّنَ الْجِنِّ أَنَا آتِيكَ بِهِ قَبْلَ أَن تَقُومَ مِن مَّقَامِكَ ۖ وَإِنِّي عَلَيْهِ لَقَوِيٌّ أَمِينٌ قَالَ الَّذِي عِندَهُ عِلْمٌ مِّنَ الْكِتَابِ أَنَا آتِيكَ بِهِ قَبْلَ أَن يَرْتَدَّ إِلَيْكَ طَرْفُكَ ۚ فَلَمَّا رَآهُ مُسْتَقِرًّا عِندَهُ قَالَ هَٰذَا مِن فَضْلِ رَبِّي
জ্বীনদের মাঝে এক দৈত্য বলল: ‘আপনি আপনার জায়গা থেকে ওঠার আগেই আমি তা আপনার কাছে নিয়ে আসছি। আর এ কাজ করার জন্য আমি অবশ্যই শক্তিমান ও বিশ্বস্ত।’ যার কাছে কিতাবের জ্ঞান ছিল সে বলল: ‘আপনার চোখ আপনার দিকে ফেরার আগেই (চোখের পলকের মাঝেই) আমি আপনাকে তা এনে দেব।’ অতঃপর সুলাইমান যখন তার সামনে সিংহাসনটি স্থির দেখতে পেল তখন বলল: ‘এটা আমার প্রভুর অনুগ্রহ’।”[সূরা নামল: ৩৯-৪০]
জীনদের খাদ্য ও পানীয়:
জীনেরা খাদ্য গ্রহণ করে এবং পানীয় পান করে। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “জীনদের পক্ষ থেকে এক আহ্বানকারী আমাকে নিতে আসল। আমি তার সাথে গেলাম এবং তাদেরকে কুরআন পাঠ করে শুনালাম।” রাবী (ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: (নবীজী বলেন:) সে আমাদেরকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে তাদের বিভিন্ন নিদর্শন ও আগুনের চিহ্ন দেখাল। তারা তাঁর কাছে খাদ্য চেয়ে বসলে তিনি বললেন: “যে জন্তু আল্লাহর নামে জবাই করা হয়েছে তার হাড় তোমাদের খাদ্য। তোমাদের হাতের স্পর্শে তা পুনরায় গোশতে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। পশুর বিষ্ঠা তোমাদের পশুর খাদ্য।” তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে (সাহাবীদেরকে) বললেন: “তোমরা এগুলো ঢিলা হিসেবে ব্যবহার করবে না। কেননা এগুলো তোমাদের ভাই জীনদের খাদ্য।”[হাদীসটি মুসলিম (৪৫০) বর্ণনা করেন]
অন্য বর্ণনায়, ‘আমার কাছে নাসীবীন অঞ্চলের জীনদের প্রতিনিধি দল এসেছিল। তারা ভালো জীন ছিল। তারা আমার কাছে খাদ্যদ্রব্য চাইলে আমি তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম যে তারা যেন কোনো হাড় বা গোবর পেলেই তাতে তারা খাদ্য পেয়ে যায়।’[হাদীসটি বুখারী (৩৫৭১) বর্ণনা করেন] সুতরাং যে সমস্ত পশু আল্লাহর নামে যবেহ করা হয়েছে তার হাড় ঈমানদার জীনদের জন্য। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য আল্লাহর নাম ছাড়া যবেহকৃত পশু বৈধ করেননি। যে পশু যবেহ করার ক্ষেত্রে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি, তা কাফের জীনদের জন্য।
জীনদের পশু:
ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত উপর্যুক্ত হাদীস অনুসারে জীনরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে খাদ্যদ্রব্য চাইলে তিনি বললেন: ... সব রকমের বিষ্ঠা ও গোবর তোমাদের পশুর খাদ্য।
জীনদের বাসস্থান:
আমরা যে পৃথিবীপৃষ্ঠে বসবাস করি জীনেরা তার উপরেই বসবাস করে। পোড়োবাড়ি ও অপরিষ্কার জায়গা যেমন বাথরুম, টয়লেট, আবর্জনা ও কবরস্থানে তারা বেশি পরিমাণে থাকে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা হচ্ছে এই সমস্ত স্থানে প্রবেশের ক্ষেত্রে সুরক্ষার মাধ্যমগুলো গ্রহণ করা। আর সেটা হলো শরীয়তসম্মত যিকির-আযকার পড়ার মাধ্যমে। এর দলীল হচ্ছে আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদীস, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শৌচাগারে প্রবেশের সময় বলতেন: اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْخُبْثِ وَالْخَبَائِثِ “হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট দুষ্ট পুরুষ জীন ও নারী জীন থেকে আশ্রয় চাচ্ছি।”[হাদীসটি বুখারী (১৪২) ও মুসলিম (৩৭৫) বর্ণনা করেন] খাত্তাবী বলেন: خُبُث শব্দটি خَبِيْثٌ এর বহুবচন। আর خبائثশব্দটি خبيثة এর বহুবচন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য পুরুষ ও নারী শয়তান জীন।
মুমিন জীন ও কাফের জীন:
মহান আল্লাহ জীনদের ব্যাপারে বলেন:
وَأَنَّا مِنَّا الْمُسْلِمُونَ وَمِنَّا الْقَاسِطُونَ فَمَنْ أَسْلَمَ فَأُولَئِكَ تَحَرَّوْا رَشَدًا (14) وَأَمَّا الْقَاسِطُونَ فَكَانُوا لِجَهَنَّمَ حَطَبًا (15)
“আমাদের মাঝে মুসলিমেরা (আত্মসমর্পণকারীরা) আছে, আবার আমাদের মাঝে বিপথগামীরাও আছে। যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাঁরাই সঠিক পথ খুঁজে নিয়েছে। আর যারা বিপথগামী তারা হবে জাহান্নামের জ্বালানি।”[সূরা জীন: ১৪-১৫]
বরং তাদের মধ্যে যারা মুসলিম নেককাজ ও আল্লাহর আনুগত্যের ক্ষেত্রে তাদের মাঝেও তারতম্য রয়েছে। আল্লাহ তাআলা একই সূরায় বলেন: وَأَنَّا مِنَّا الصَّالِحُونَ وَمِنَّا دُونَ ذَلِكَ كُنَّا طَرَائِقَ قِدَدًا “আমাদের মাঝে কতক আছে সৎকর্মপরায়ণ; আর কতক এর ব্যতিক্রম। আমরা হলাম নানান মতের অনুসারী বিভিন্ন দল।”[সূরা জীন: ১১]
এই উম্মতের প্রথম প্রজন্মের জীনদের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে: তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কয়েকজন সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে উকায বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। এ সময়ে দুষ্ট জীনদের ঊর্ধ্বলোকের সংবাদ সংগ্রহের পথে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিল এবং তাদের দিকে অগ্নিপিণ্ড নিক্ষিপ্ত হল। ফলে শয়তানরা নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসল। তাদের সম্প্রদায় জিজ্ঞাসা করল: ‘তোমাদের কী হয়েছে?’ তারা বলল: ‘আমাদের ও আকাশের সংবাদ সংগ্রহের মাঝে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে এবং আমাদের দিকে অগ্নিপিণ্ড ছুঁড়ে মারা হয়েছে।’ তখন তারা বলল: ‘নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু ঘটেছে বলেই তোমাদের ও আকাশের সংবাদ সংগ্রহের মধ্যে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। তাই পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চল পর্যন্ত বিচরণ করে দেখ, কী কারণে তোমাদের ও আকাশের সংবাদ সংগ্রহের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে?’ ফলে তাদের যে দলটি তিহামার দিকে গিয়েছিলো, তারা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে অগ্রসর হল। তিনি তখন উকায বাজারের পথে নাখ্লা নামক স্থানে সাহাবীগণকে নিয়ে ফজরের নামায আদায় করছিলেন। তারা যখন কুরআন পাঠ শুনতে পেল, তখন কুরআনের দিকে মনোযোগ দিল। অতঃপর তারা বলে উঠলো: ‘আল্লাহর শপথ! এটিই তোমাদের ও আকাশের সংবাদ সংগ্রহের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। এরপর যখন তারা সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে আসল, তারা বলল: ‘হে আমাদের সম্প্রদায়! আমরা এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি, যা সঠিক পথ নির্দেশ করে, ফলে আমরা এতে ঈমান এনেছি এবং কখনো আমরা আমাদের প্রতিপালকের সঙ্গে কাউকে শরীক করব না।’ এ প্রেক্ষাপটেই আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সূরা জীন নাযিল করেন। মূলতঃ তাঁর নিকট জীনদের বক্তব্যই ওহীরূপে অবতীর্ণ করা হয়েছে।[হাদীসটি বুখারী (৭৩১) বর্ণনা করেন]
কিয়ামতের দিন তাদের হিসাব:
কিয়ামতের দিন জীনদের হিসাব নেওয়া হবে। মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ আল্লাহর বাণী: وَلَقَدْ عَلِمَتِ الْجِنَّةُ إِنَّهُمْ لَمُحْضَرُونَ “আর জীনেরা অবশ্যই জানে যে তাদেরকে হাজির করা হবে।”-এর ব্যাখ্যায় বলেন: ‘হিসাবের জন্য হাজির করা হবে।’[সহীহ বুখারী: বাবু যিকরিল জিন্নি ওয়া-সাওয়াবিহিম ওয়া-ইক্বাবিহিম]
জীনদের অনিষ্ট থেকে সুরক্ষা:
জীনরা যেহেতু আমাদেরকে দেখতে পায় কিন্তু আমরা তাদেরকে দেখতে পাই না সেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থেকে বাঁচার বহুবিধ পন্থা আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। যেমন: আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় চাওয়া। সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়া।
এছাড়া আল্লাহর কাছে তার এই বাণীর মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনা করা:
وَقُلْ رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ (97) وَأَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَحْضُرُونِ
“আর বলুন: ‘হে আমার প্রভু! শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই। হে আমার প্রভু! আমার কাছে তারা উপস্থিত হওয়া থেকেও আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই।”[সূরা মূমিনুন: ৯৭-৯৮]
অনুরূপভাবে ঘরে প্রবেশ করা, খাবার গ্রহণ করা, পানীয় পান করা, সহবাস করা প্রভৃতির পূর্বে বিসমিল্লাহ পাঠ করা শয়তানকে মানুষের ঘরে রাত্রি-যাপন করা থেকে, মানুষের সাথে খাদ্য-পানীয় গ্রহণ ও সহবাস করা থেকে বাধা দেয়। একইভাবে শৌচাগারে প্রবেশের আগে ও কাপড় খোলার আগে বিসমিল্লাহ বলা জীনকে মানুষের গোপনাঙ্গ দেখতে ও তার ক্ষতি করতে বাধা দেয়। এর দলীল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “জীন ও মানুষের গোপন অঙ্গের মাঝখানের পর্দা হলো শৌচাগারে প্রবেশকালে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা।”[হাদীসটি তিরমিযী (৫৫১) বর্ণনা করেন। এটি সহীহুল জামে গ্রন্থে আছে]
ব্যক্তির ঈমান ও দ্বীনের দৃঢ়তা তাকে জীনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে বাধা দেয়। বরং এমনও হয় যে তারা যদি কোনো লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় তাহলে ঈমানদার সেই লড়াইয়ে বিজয়ী হয়। এর দলীল হচ্ছে ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনা, তিনি বলেন: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক সাহাবী এক জীনের সাক্ষাৎ পেল। তারা কুস্তি শুরু করলে মানুষটা তাকে পরাজিত করে দিল। তারপর মানুষটি তাকে বলল: ‘আমি তো দেখতে পাচ্ছি তুমি খুব ছিপছিপে লিকলিকে। তোমার দুই বাহু যেন কুকুরের বাহু। তোমরা জীনেরা কি এমন নাকি তুমি তাদের মাঝে এমন?’ জীন বলল: ‘না, বরং আমি তাদের মাঝে শক্ত-পোক্ত। কিন্তু আমার সাথে আরেকবার লড়াই করো। এবার আমাকে পরাজিত করলে তোমাকে এমন কিছু শিখিয়ে দিব যা তোমার উপকারে আসবে।’ মানুষটি বলল: ‘হ্যাঁ’। সে বলল: ‘তুমি আয়াতুল কুরসী পড়বে।’ সে বলল: ‘হ্যাঁ’। জীন বলল: ‘তুমি কোনো ঘরে এই আয়াত পড়লে শয়তান গাধার মত বায়ুত্যাগ করতে করতে চলে যাবে, তারপর সকাল হওয়ার আগে সে ঘরে ঢুকবে না।’[হাদীসটি দারেমী (৩২৪৭) বর্ণনা করেন]
এটি জীনদের স্বরূপ, প্রকৃতি ও স্বভাব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ। আল্লাহই উত্তম সংরক্ষণকারী, তিনি সর্বাধিক দয়ালু।
আরো জানতে শাইখ উমর সুলাইমান আল-আশক্বার রচিত ‘আলামুল জিন্নি ওয়াশ-শায়াত্বীন’ গ্রন্থটি পড়ুন।