রবিবার 21 জুমাদাল ছানী 1446 - 22 ডিসেম্বর 2024
বাংলা

তাওয়াফের শর্ত ও ওয়াজিবসমূহ

প্রশ্ন

তাওয়াফের শর্ত ও ওয়াজিবগুলো কি কি?

আলহামদু লিল্লাহ।.

কাবাগৃহের চর্তুদিকে তাওয়াফ (প্রদক্ষিণ) শুদ্ধ হওয়ার জন্য আলেমগণ কিছু শর্ত উল্লেখ করেছেন, সেগুলো হচ্ছে:

১। মুসলমান হওয়া। এটি আলেমদের সর্বসম্মত শর্ত। তাই কোন কাফেরের তাওয়াফ শুদ্ধ হবে না। কেননা তাওয়াফ একটি ইবাদত। কাফের কর্তৃক সম্পাদিত কোন ইবাদত শুদ্ধ নয় ও কবুলযোগ্য নয়।

২। বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া। এটি হানাফি ও হাম্বলি মাযহাবের আলেমদের অভিমত। মালেকি ও শাফেয়ি মাযহাবের আলেমগণ এ শর্ত করেননি। তারা ‘বুঝবান বালকের অভিভাবক তার পক্ষ থেকে নিয়ত করলে বালকের তাওয়াফ শুদ্ধ হওয়া’ এর উপর কিয়াস করেছেন।

৩। নিয়ত করা। এটি আলেমদের সর্বসম্মত শর্ত। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “নিশ্চয় সকল আমল নিয়্যত অনুযায়ী মূল্যায়িত হয় এবং মানুষ যা নিয়্যত করে সে তা-ই পায়”[সহিহ বুখারী (১) ও সহহি মুসলিম(১৯০৭)]

৪। সতর ঢাকা থাকা। কেউ উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করে তাহলে তার তাওয়াফ শুদ্ধ হবে না। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্জের মৌসুমে ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন: “এ বছরের পর (অর্থাৎ নবম হিজরির পর) কোন মুশরিক হজ্জে আসবে না এবং কোন উলঙ্গ ব্যক্তি বায়তুল্লাহ্‌ তাওয়াফ করবে না।”[সহিহ বুখারী (৩৬৯) ও সহিহ মুসলিম (১৩৪৭)]

শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন: যদি কোন উলঙ্গ ব্যক্তি তাওয়াফ করে তাহলে তাওয়াফ শুদ্ধ হবে না। কেননা তা করা নিষিদ্ধ। এ ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী হচ্ছে, “যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করে যাতে আমাদের অনুমোদন নেই সেটা প্রত্যাখ্যাত।”[আল-শারহুল মুমতি’ (৭/২৫৭) থেকে সমাপ্ত]

৫। লঘু অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়া। ইতিপূর্বে 34695 নং প্রশ্নোত্তরে এ শর্তের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

৬। জমহুর আলেমদের মতে, পোশাক ও শরীর নাপাকি থেকে পবিত্র হওয়া। এ সংক্রান্ত আলেমদের মতভেদ, ইতিপূর্বে 136742 নং প্রশ্নোত্তরে আলোচনা করা হয়েছে।

৭। পরিপূর্ণ সাত চক্কর তাওয়াফ করা। সাত চক্করের চেয়ে এক কদমও কম হলে তাওয়াফ পরিপূর্ণ হবে না। ইমাম নববী বলেন: তাওয়াফের শর্ত হচ্ছে, সাত চক্কর হওয়া। প্রত্যেকবার হাজারে আসওয়াদ থেকে শুরু করে হাজারে আসওয়াদ শেষ করবে। যদি সাত চক্করের চেয়ে এক কদমও কম হয় তাহলে তার তাওয়াফ ধর্তব্য হবে না। চাই সে ব্যক্তি মক্কাতে অবস্থান করুক কিংবা মক্কা থেকে বের হয়ে তার নিজ দেশে ফিরে আসুক। দম বা পশু জবাই করে কিংবা অন্য কোন আমলের মাধ্যমে তাওয়াফের ঘাটতিকে পূরণ করা সম্ভবপর নয়।[আল-মাজউ (৮/২১)]

৮। বায়তুল্লাহ্‌কে বাম দিকে রেখে তাওয়াফ করা। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বায়তুল্লাহ্‌কে বামে রেখে তাওয়াফ করেছেন এবং তিনি বলেছেন “তোমরা আমার কাছ থেকে হজ্জের কার্যাবলি শিখে নাও।”[সহিহ মুসলিম (১২৯৭) এ জাবির (রাঃ) এর হাদিস]

৯। বায়তুল্লাহ্‌র সম্পূর্ণ অংশকে ঘিরে তাওয়াফ করা। সুতরাং কেউ যদি দূরত্ব কমানোর জন্য হাতীম বা হিজর (কাবার ভিটার অংশ) এর ভেতর দিয়ে তাওয়াফ করে তার তাওয়াফ সহিহ নয়। আরও জানতে দেখুন: 46597 নং প্রশ্নোত্তর।

১০। হাঁটতে সক্ষম হলে হেঁটে হেঁটে তাওয়াফ করা: এটি শাফেয়ি মাযহাবের আলেমগণ ছাড়া জমহুর আলেমের অভিমত।

শাইখ বিন উছাইমীন (রহঃ) বলেন:

“আমার কাছে যা পরিস্কার হয়েছে যে, তাওয়াফকালে আরোহণ করা জায়েয নয়। সেটা উটের পিঠে হোক কিংবা কাঁধের উপর হোক কিংবা হুইল চেয়ারে হোক; একান্ত প্রয়োজনের মুখাপেক্ষী ব্যক্তি ছাড়া।

প্রয়োজন: যেমন- অসুস্থতা, বার্ধক্য, তীব্র ভীড়; যা সওয়া তার পক্ষে সম্ভবপর নয়। কেননা কিছু কিছু মানুষ ভিড় সহ্য করতে পারে; আর কিছু কিছু মানুষ ভীড় সহ্য করতে পারে না। অর্থাৎ যদি কোন ওজরের কারণে হয় তাহলে (আরোহন) জায়েয হবে; যদি কোন ওজরের কারণে না হয় তাহলে জায়েয হবে না।[শারহু কিতাবিল হাজ্জ মিন সাহিহিল বুখারী (১/৮৩)]

১১। চক্করগুলোর মাঝে পরম্পরা রক্ষা করা: ইতিপূর্বে 219227 নং প্রশ্নোত্তরে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

১২। মসজিদে হারামের ভেতর দিয়ে তাওয়াফ করা: কেননা তাওয়াফের ক্ষেত্রে ফরয হচ্ছে বায়তুল্লাহ্‌কে তাওয়াফ করা। যদি কেউ মসজিদে হারামের বাহিরে দিয়ে তাওয়াফ করে তাহলে সে মসজিদকে তাওয়াফ করল; বায়তুল্লাহ্‌কে নয়।

শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন:

আলেমগণ বলেন: তাওয়াফ সহিহ হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে মসজিদে হারামের ভেতরে হওয়া। মসজিদের বাহিরে দিয়ে তাওয়াফ করে তাহলে আদায় হবে না। এজন্য কেউ যদি মসজিদে হারামের বাহিরে দিয়ে তাওয়াফ করতে চায় তাহলে সেটা জায়েয হবে না। কেননা সেক্ষেত্রে সে মসজিদকে তাওয়াফকারী হবে; কাবাকে নয়। আর যারা মসজিদের ভেতরে উপরে কিংবা নীচে দিয়ে তাওয়াফ করেন তাদের তাওয়াফ জায়েয হবে। তবে, সাফা-মারওয়া দিয়ে কিংবা সাফা-মারওয়ার উপর দিয়ে তাওয়াফ করা থেকে সাবধান। কেননা সাফা-মারওয়া মসজিদের অংশ নয়।[তাফসিরু সুরাতিল বাক্বারা, (২/৪৯)]

১৩। হাজারে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফ শুরু করা। কেউ যদি কাবার ফটক থেকে তাওয়াফ শুরু করে তাহলে তার তাওয়াফ অপূর্ণ ও অশুদ্ধ হবে।

শাইখ উছাইমীন বলেন:

কিছু কিছু লোক কাবার ফটক থেকে তাওয়াফ শুরু করেন; হাজারে আসওয়াদ থেকে নয়। যে ব্যক্তি কাবার ফটক থেকে তাওয়াফ শুরু করবে এবং এর উপর ভিত্তি করে তাওয়াফ শেষ করবে তার তাওয়াফ পরিপূর্ণ হবে না। কেননা আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:  “এবং তাওয়াফকরে প্রাচীন গৃহের”[সূরা হাজ্জ, আয়াত: ২৯] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাজারে আসওয়াদ থেকে তাঁর তাওয়াফ শুরু করেছেন এবং মানুষকে বলেছেন: “তোমরা আমার কাছ থেকে হজ্জের কার্যাবলি গ্রহণ কর।” তাই যে ব্যক্তি কাবাগৃহের ফটকের নিকট থেকে কিংবা হাজারে আসওয়াদের সমান্তরালের সামান্য কিছু পর থেকে তাওয়াফ শুরু করে সেক্ষেত্রে তার এ চক্করটি বাতিল। কেননা সে ব্যক্তি পরিপূর্ণ চক্কর পালন করেনি। তার কর্তব্য হবে নিকটবর্তী সময়ের মধ্যে স্মরণ হলে এর পরিবর্তে অন্য একটি চক্কর আদায় করা। আর যদি নিকটবর্তী সময়ের মধ্যে স্মরণে না পড়ে তাহলে সম্পূর্ণ তাওয়াফ নতুনভাবে পালন করা।[মাজমুউল ফাতাওয়া (২২/৪০৪)]

এই হচ্ছে তাওয়াফ শুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি।

আর তাওয়াফের ওয়াজিবসমূহ হচ্ছে:

কোন কোন আলেমের মতে, তাওয়াফের দুই রাকাত নামায ওয়াজিব। তবে, সঠিক মতানুযায়ী, এ দুই রাকাত নামায সুন্নত। এটি ইমাম শাফেয়ি ও ইমাম আহমাদের মাযহাব।

শাইখ বিন বায (রহঃ) তাওয়াফের দুই রাকাত নামায সম্পর্কে বলেন: “মাকামে ইব্রাহিমের পেছনে হওয়া আবশ্যক নয়। মসজিদে হারামের যে কোন স্থানে পড়লেও আদায় হবে। আর কেউ এ নামায পড়তে ভুলে গেলেও অসুবিধা নেই। কেননা এটি সুন্নত নামায; ওয়াজিব নয়।”।[মাজমুউ ফাতাওয়াস শাইক বিন বায, (১৭/২২৮)]

আলেমগণ এ ছাড়া আরও যেসব ওয়াজিব উল্লেখ করে থাকেন সেগুলো পূর্বোল্লেখিত শর্তাবলির অন্তর্ভুক্ত। তবে, কোন কোন আলেম এগুলোকে ওয়াজিব হিসেবে উল্লেখ করেন; শর্ত হিসেবে নয়।

দেখুন: ড. আব্দুল্লাহ্‌ আল-যাহিম এর ‘শুরুতুত তাওয়াফ’ (তাওয়াফের শর্তাবলি) শীর্ষক গবেষণা; যে গবেষণাটি ‘আল-বুহুছ আল-ইসলামিয়্যা’ নামক গবেষণা পত্রিকার ৫৩তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে এবং তাঁর আরও একটি গবেষণা ‘ওয়াজিবাতুত তাওয়াফ’; যা প্রাগুক্ত গবেষণা পত্রিকার ৫৮তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

সংশ্লিষ্ট প্রশ্নোত্তরসমূহ