সোমবার 29 জুমাদাল ছানী 1446 - 30 ডিসেম্বর 2024
বাংলা

ঈদের আদবসমূহ

প্রশ্ন

কোন কোন সুন্নত ও আদবগুলো আমরা ঈদের দিন পালন করতে পারি?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

ঈদের দিন একজন মুসলিম যে সুন্নতগুলো পালন করতে পারেন সেগুলো নিম্নরূপ:

১। নামাযে যাওয়ার আগে গোসল করা:

মুয়াত্তা ও অন্যান্য গ্রন্থে সহিহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ্‌ বিন উমর (রাঃ) ঈদের দিন ঈদগাহে যাওয়ার আগে গোসল করতেন।[মুয়াত্তা (৪২৮)]

ইমাম নববী (রহঃ) ঈদের নামাযের জন্য গোসল করা মুস্তাহাব মর্মে আলেমদের মতৈক্য উল্লেখ করেছেন।

যে কারণে জুমার নামায ও অন্যান্য সাধারণ সম্মিলনের জন্য গোসল করা মুস্তাহাব ঠিক একই কারণ ঈদের ক্ষেত্রেও পাওয়া যায়। বরং ঈদের ক্ষেত্রে সে কারণটি আরও বেশি স্পষ্ট।

২। ঈদুল ফিতরের নামাযে যাওয়ার আগে কিছু খাওয়া এবং ঈদুল আযহার নামাযের পরে খাওয়া:

ঈদুল ফিতরের নামাযে যাওয়ার আগে কিছু খেজুর খেয়ে যাওয়া অন্যতম একটি শিষ্টাচার। যেহেতু সহিহ বুখারীতে আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কয়েকটি খেজুর খেয়ে ঈদগাহে যেতেন...। তিনি বেজোড় সংখ্যক খেজুর খেতেন।[সহিহ বুখারী (৯৫৩)]

নামাযে যাওয়ার আগে খাওয়া মুস্তাহাব এই কারণে যাতে করে সেই দিনে রোযা রাখা নিষিদ্ধ হওয়ার উপর তাগিদ দেওয়া যায় এবং পানাহার করা ও রোযা সমাপ্তির ঘোষণা দেওয়া যায়।

ইবনে হাজার (রহঃ) এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে যাতে করে রোযার সংখ্যা বৃদ্ধির পথ রুদ্ধ করে দেওয়া যায় এবং এর মাধ্যমে অবিলম্বে আল্লাহ্‌র নির্দেশ পালন পাওয়া যায়।[ফাতহুল বারী (২/৪৪৬)]

কারো কাছে যদি খেজুর না থাকে তাহলে সে যেন অন্য হালাল কিছু খেয়ে নেয়।

আর ঈদুল আযহার ক্ষেত্রে নামায থেকে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত কোন কিছু না খাওয়া মুস্তাহাব। নামায থেকে ফিরে এসে কোরবানীর গোশত খাবে; যদি সে কোরবানী দিয়ে থাকে। আর কোরবানী না দিলে নামাযের আগে খেতে কোন অসুবিধা নেই।

৩। ঈদের দিনে তাকবীর দেওয়া:

এটি ঈদের দিনের মহান সুন্নত। দলিল হচ্ছে আল্লাহ্‌র বাণী: "তিনি চান তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি যে তোমাদেরকে নির্দেশনা দিয়েছেন সে জন্য তাকবির উচ্চারণ কর (আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর) এবং যাতে তোমরা শোকর কর।"[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৮৫]

ওয়ালিদ বিন মুসলিম বলেন: আমি আওযায়ি ও মালেক বিন আনাসকে দুই ঈদের দিন উচ্চস্বরে তাকবির দেওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি। তাঁরা উভয়ে বলেছেন: হ্যাঁ। আব্দুল্লাহ্‌ বিন উমর (রাঃ) ঈদুল ফিতরের দিন ইমাম আসার আগ পর্যন্ত উচ্চস্বরে তাকবির দিতেন।

আবু আব্দুর রহমান আস্‌-সুলামি থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: "তাঁরা ঈদুল আযহার তাকবিরের চেয়ে ঈদুল ফিতরের ব্যাপারে বেশি কঠোর ছিলেন।" ওকী বলেন: বুঝাতে চাচ্ছেন: তাকবিরের ব্যাপারে।[দেখুন: ইরওয়াউল গালিল (৩/১২২)]

দ্বারা কুতনী ও অন্যান্য গ্রন্থাকার বর্ণনা করেছেন যে, ইবনে উমর (রাঃ) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন সকালে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবীর দিতে থাকতেন। এরপরও ইমাম আসার আগ পর্যন্ত তাকবীর দিতে থাকতেন।

ইবনে আবু শাইবা সহিহ সনদে যুহরী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: লোকেরা ঈদের সময় যখন তাদের ঘর থেকে বের হত তখন থেকে ঈদগাহে আসা পর্যন্ত এবং ইমাম আসা পর্যন্ত তাকবীর দিতে থাকত। যখন ইমাম এসে যেত তখন সবাই চুপ হয়ে যেত। ইমাম যখন তাকবীর দিতেন তখন তারাও তাকবীর দিতেন।[দেখুন: ইরওয়াউল গালিল (২/১২১)]

ঘর থেকে বের হওয়া থেকে শুরু করে ঈদগাহে আসা পর্যন্ত ও ইমাম আসা পর্যন্ত তাকবীর দেওয়ার বিষয়টি সালাফদের মাঝে মশহুর ছিল। একদল গ্রন্থাকার এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। যেমন- ইবনে আবু শাইবা, আব্দুর রাজ্জাক, ফিরইয়াবি 'আহকামুল ঈদাইন' গ্রন্থে একদল সালাফ থেকে বর্ণনা করেছেন। এ বর্ণনাগুলোর মধ্যে রয়েছে যে, নাফে বিন জুবাইর নিজে তাকবীর দিতেন এবং লোকদের তাকবীর না দেওয়া দেখে বিস্মিত হয়ে বলতেন: আপনারা কি তাকবীর দিবেন না?

ইবনে শিহাব আয-যুহরী বলেন: লোকেরা বাড়ী থেকে বের হওয়ার সময় থেকে ইমাম আসার আগ পর্যন্ত তাকবীর দিতেন।

ঈদুল ফিতরের তাকবীর দেওয়ার সময় হচ্ছে- ঈদের রাত থেকে শুরু করে ঈদের নামাযের ইমাম হাযির হওয়া পর্যন্ত।

আর ঈদুল আযহার তাকবীর জিলহজ্জ মাসের প্রথম দিন থেকে তাশরিকের সর্বশেষ দিন সূর্য ডোবা পর্যন্ত।

তাকবীর দেওয়ার পদ্ধতি:

মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবাতে সহিহ সনদে ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে উদ্ধৃত হয়েছে যে, তিনি তাশরিকের দিনগুলোতে এভাবে তাকবির দিতেন:

 الله أكبر الله أكبر لا إله إلا الله والله أكبر الله أكبر ولله الحمد

(উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ)(অনুবাদ: আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। আল্লাহ্‌ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। আল্লাহ্‌ মহান, আল্লাহ্‌ মহান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য।)[ইবনে আবি শাইবা অন্যস্থানে একই সনদে 'তাকবির' তিনবার দেওয়ার বর্ণনা উল্লেখ করেছেন]

আল-মুহামিলি সহিহ সনদে ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন:

الله أكبر كبيراً الله أكبر كبيراً الله أكبر وأجلّ ، الله أكبر ولله الحمد 

(উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার কাবিরা। আল্লাহু আকবার কাবিরা। আল্লাহু আকবার ওয়া আজাল্ল। আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ)। (অনুবাদ: আল্লাহ সবচেয়ে বড় অতীব বড়। আল্লাহ সবচেয়ে বড় অতীব বড়। আল্লাহ সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত। সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য।)[দেখুন: আল-ইরওয়া (৩/১২৬)]

৪। শুভেচ্ছা বিনিময় করা:

ঈদের শিষ্টাচারের মধ্যে রয়েছে পরস্পরের মাঝে উত্তম পদ্ধতিতে শুভেচ্ছা বিনিময় করা। সে শুভেচ্ছার ভাষা যে ধরণেরই হোক না কেন। যেমন কেউ কেউ বলেন: تقبل الله منا ومنكم (তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম)(অনুবাদ: আল্লাহ্‌ আমাদের ও আপনাদের নেক আমলগুলো কবুল করে নিন)। কিংবা عيد مبارك (ঈদ মোবারক) কিংবা এ ধরণের অন্য যে কোন বৈধ ভাষায়।

জুবাইর বিন নুফাইর থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ঈদের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীবর্গ যখন একে অপরের সাথে সাক্ষাত করতেন তখন বলতেন: تُقُبِّل منا ومنك (তুকুব্বিলা মিন্না ও মিনকা) (অনুবাদ: আমাদের আমল ও আপনার আমল কবুল হোক)। ইবনে হাজার বলেন: এর সনদ সহিহ।[আল-ফাতহ (২/৪৪৬)]

সাহাবায়ে কেরামের মাঝে শুভেচ্ছাজ্ঞাপনের প্রথা চালু ছিল। ইমাম আহমাদ ও অন্যান্য আলেমগণ এ ক্ষেত্রে রুখসত (ছাড়) দিয়েছেন।

এমন কিছু বর্ণনা রয়েছে যা বিভিন্ন উপলক্ষে শুভেচ্ছাজ্ঞাপন শরিয়তসম্মত হওয়ার প্রমাণ বহন করে। আনন্দদায়ক কিছু ঘটলে সাহাবায়ে কেরাম পরস্পরকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের উদাহরণ হচ্ছে- আল্লাহ্‌ যখন কোন এক ব্যক্তির তাওবা কবুল করলেন তখন তারা উঠে এ উপলক্ষে তাকে শুভেচ্ছা জানালেন।

নিঃসন্দেহে এ ধরণের শুভেচ্ছাজ্ঞাপন উন্নত আখলাক ও মুসলিম সমাজের সুন্দর রীতিগুলোর অন্তর্ভুক্ত। শুভেচ্ছাজ্ঞাপনের ব্যাপারে নিদেনপক্ষে এতটুকু বলতে হবে যে, কেউ যদি আপনাকে ঈদ উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানায় তাহলে আপনিও তাকে শুভেচ্ছা জানান। আর কেউ যদি চুপ থাকে আপনিও চুপ থাকতে পারেন; যেমনটি বলেছেন ইমাম আহমাদ (রহঃ): যদি কেউ আমাকে শুভেচ্ছা জানায় আমি এর প্রত্যুত্তর দিই; তবে আমি শুরুতে শুভেচ্ছা জানাই না।

৫। ঈদ উপলক্ষে সুন্দর পোশাকাদি পরিধান করা:

আব্দুল্লাহ্‌ বিন উমর (রাঃ) বলেন: একবার উমর (রাঃ) রেশমের তৈরী একটি জুব্বা, যা বাজারে বিক্রির জন্য তোলা হয়েছিল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে এসে বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ্‌! আপনি এ জুব্বাটি কিনুন; ঈদের সময় ও প্রতিনিধি দলের সাথে সাক্ষাতের সময় এ সুন্দর পোশাকটি পরবেন। তখন রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন: "এটি এমন ব্যক্তির পোশাক যার কোন ভাগ বা অংশ নেই (অর্থাৎ তাকওয়া ও সওয়াবের)।"[সহিহ বুখারী (৯৪৮)]

অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদ উপলক্ষে সুন্দর পোশাক পরার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন। কিন্তু তিনি এ জুব্বা কিনতে সম্মতি দেননি; যেহেতু সেটি ছিল রেশমের তৈরী জুব্বা।

জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এমন একটি জুব্বা ছিল যেটা তিনি দুই ঈদের সময় ও জুমার দিন পরতেন।[সহিহ ইবনে খুযাইমা (১৭৬৫)]

ইমাম বাইহাকী সহিহ সনদে বর্ণনা করেন যে, ইবনে উমর (রাঃ) ঈদের জন্য তার সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটি পরতেন।

তাই্ যে কোন ব্যক্তির উচিত হচ্ছে ঈদের নামাযে যাওয়ার সময় নিজের যে পোশাকটি সবচেয়ে সুন্দর সেটা পরে যাওয়া।

তবে, নারীরা যখন নামাযে যাবেন তখন সাজসজ্জা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবেন। যেহেতু বেগানা পুরুষদের কাছে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ করা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে যে নারী ঈদের নামাযে যেতে চায় তার জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করা কিংবা পুরুষদেরকে আকৃষ্ট করাও হারাম। কেননা তিনি ইবাদতের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে বের হননি।

৬। নামাযের জন্য এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া অন্য রাস্তা দিয়ে ফেরত আসা:

জাবের বিন আব্দুল্লাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দিন ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা ব্যবহার করতেন।[সহিহ বুখারী (৯৮৬)]

এ আমলের হেকমত সম্পর্কে বলা হয় যাতে করে কিয়ামতের দিন উভয় রাস্তা আল্লাহ্‌র কাছে তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। কিয়ামতের দিন জমিনের উপর ভালমন্দ যা আমল করা হয়েছে জমিন সেটা বলে দিবে।

এর হেকমত সম্পর্কে অন্য একটি অভিমত হচ্ছে উভয় রাস্তায় ইসলামের নিদর্শনকে জাহির করা।

আরেকটি অভিমত হচ্ছে- আল্লাহ্‌র যিকিরকে ফুটিয়ে তোলা।

আরেকটি অভিমত হচ্ছে- মুনাফিক ও ইহুদীদেরকে ক্ষেপিয়ে তোলা এবং তাঁর সাথে কত বেশি মানুষ রয়েছে সেটা তাদের কাছে তুলে ধরা।

আরেকটি অভিমত হচ্ছে- যাতে করে তিনি মানুষকে ফতোয়া জানানো, তালিম দেওয়া, অনুসরণ করা মানুষের ইত্যাদি প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন কিংবা অভাবীদেরকে সদকা করতে পারেন কিংবা আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতে পারেন।   

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ। 

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব