রবিবার 21 জুমাদাল ছানী 1446 - 22 ডিসেম্বর 2024
বাংলা

মসজিদে নববী যিয়ারতের সময় যেসব ভুল হয়ে থাকে

প্রশ্ন

প্রশ্ন: আমি মসজিদে নববী যিয়ারত করার সময় লক্ষ্য করেছি কিছু মানুষ নবীজির হুজরার দেয়াল মোছন করেন। কেউ কেউ কবরের সামনে বুকের উপর হাত রেখে এমনভাবে দাঁড়ান যেভাবে নামাযে দাঁড়ায়; তাদের এ আমলগুলো কি সঠিক?

আলহামদু লিল্লাহ।.

আলহামদুলিল্লাহ।

ইতিপূর্বে 36863 নং প্রশ্নোত্তরে মসজিদে নববী যিয়ারত করার আদবগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। এখন যিয়ারতকারীগণ যে ভুলগুলো করে থাকেন সেগুলো উল্লেখ করব:

এক:

রাসূলকে ডাকা, বিপদমুক্তির জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করা, তাঁর সাহায্য চাওয়া। যেমন- কোন কোন লোক বলে থাকে, “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের অসুস্থ লোককে সুস্থ করে দিন; হে আল্লাহর রাসূল, আমার ঋণ পরিশোধ করে দিন, হে আমার ওসিলা, হে আমার প্রয়োজনপূর্ণের দরজা” ইত্যাদি শরিকী উক্তিগুলো; যে উক্তিগুলো বান্দার উপর আল্লাহর একক অধিকার তাওহীদের পরিপন্থী।

দুই:

কবরের সামনে নামাযের সুরতে দাঁড়ানো— ডানহাত বামহাতের উপর রেখে বুকের উপরে কিংবা নীচে রাখা। এটি হারাম কাজ। যেহেতু দাঁড়ানোর এ পদ্ধতিটি ইবাদত ও হীনতার অবস্থা। এটি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা নাজায়েয।

তিন:

কবরের কাছে ঝুঁকে পড়া, সিজদা করা কিংবা এমন কিছু করা যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা জায়েয নয়। আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “কোন মানুষের জন্য মানুষকে সিজদা করা সঙ্গত নয়”[মুসনাদে আহমাদ (৩/১৫৮), আলবানী ‘সহিহুত তারগীব’ গ্রন্থে (১৯৩৬ ও ১৯৩৭) ও ‘ইরওয়াউল গালিল’ গ্রন্থে (১৯৯৮) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন।

চার:

কবরের নিকটে আল্লাহর কাছে দোয়া করা। অথবা এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, কবরের নিকটে দোয়া করলে কবুল হয়। এটি করা হারাম। কারণ এটি শিরকে পতিত হওয়ার বাহন। যদি কবরের কাছে দোয়া করা কিংবা নবীজির কবরের কাছে দোয়া করা উত্তম হত, সঠিক হত কিংবা আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় হত তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সেটা করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে যেতেন। কেননা যা কিছু উম্মতকে জান্নাতের নৈকট্য হাছিল করিয়ে দিবে এমন কোন কিছু বর্ণনা করা থেকে তিনি বাদ দেননি। যখন তিনি এক্ষেত্রে উম্মতকে উদ্বুদ্ধ করেননি এর থেকে জানা গেল যে, এটি শরিয়তসিদ্ধ নয়; হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ। আবু ইয়ালা ও হাফেয যিয়া ‘আল-মুখতারা’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, আলী বিন হুসাইন (রাঃ) এক ব্যক্তিকে দেখলেন যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের সন্নিকটে একটি ছিদ্রতে প্রবেশ করে দোয়া করেন। তখন তিনি তাকে নিষেধ করলেন এবং বললেন: আমি তোমাদেরকে এমন একটি হাদিস বর্ণনা করব না যা আমি আমার পিতা থেকে তিনি আমার দাদা, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “তোমরা আমার কবরকে ঈদ বা উৎসবস্থল (ঈদ বলা হয় এমন স্থানকে যা বারবার পরিদর্শন করা হয়) বানিও না এবং নিজেদের ঘরগুলোকে কবর বানিও না। তোমরা আমার উপর দরুদ পড়। কেননা তোমরা যেখানেই থাক না কেন তোমাদের সালাম আমার নিকট পৌঁছানো হয়”।[সুনানে আবু দাউদ (২০৪২), আলবানী সহিহ আবু দাউদ গ্রন্থে (১৭৯৬) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

পাঁচ:

যারা মদিনা যিয়ারতে আসতে পারেনি তারা কোন কোন যিয়ারতকারীর মাধ্যমে রাসূলের কাছে সালাম প্রেরণ করা এবং যিয়ারতকারীগণ এ সালাম পৌঁছানো। এটি বিদাতী কর্ম ও নব উদ্ভাবিত কর্ম। সুতরাং ওহে সালাম প্রেরণকারী ও ওহে সালাম সমর্পনকারী এটি করা থেকে বিরত থাকুন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণীই আপনাদের জন্য যথেষ্ট: “তোমরা আমার উপর দরুদ পড়। তোমরা যেখানেই থাক না কেন তোমাদের সালাম আমার নিকট পৌঁছানো হয়।”।

আর যথেষ্ট এ বাণীটি: “নিশ্চয় আল্লাহর এমন কিছু বিচরণকারী ফেরেশতা রয়েছে যারা আমার কাছে আমার উম্মতের সালাম পৌঁছে দেয়”।[মুসনাদে আহমাদ (১/৪৪১), সুনানে নাসাঈ (১২৮২), আলবানী ‘সহিহুল জামে’ গ্রন্থে (২১৭০) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

ষষ্ঠ:

বারবার নবীজির কবর যিয়ারত করা। যেমন- প্রত্যেক ফরয নামাযের পর যিয়ারত করা কিংবা প্রতিদিন নির্দিষ্ট নামাযের শেষে যিয়ারত করা। এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “তোমরা আমার কবরকে উৎসবস্থল (বারবার যিয়ারতস্থল) বানিও না” এর সাথে সাংঘর্ষিক। ইবনে হাজার হাইছামী ‘মিশকাত’ এর ব্যাখ্যায় বলেন: ঈদ (عيد শব্দটিকে এখানে উৎসব অনুবাদ করা হয়েছে) একটি উৎসবের নাম। ঈদকে ঈদ বলা হয় যেহেতু এটি ঘুরেফিরে করা ও পুনপুন করার মাধ্যমে অভ্যাসে (عادة) পরিণত হয়ে গেছে। হাদিসের অর্থ হচ্ছে- তোমরা আমার কবরকে এমন স্থান বানিও না যেখানে বারবার, পুনপুন, বহুবার আসাটা অভ্যাস। এ কারণে তিনি বলেছেন: “তোমরা আমার উপর দরুদ পড়। কারণ তোমাদের সালাম আমার নিকট পৌঁছে দেয়া হয় তোমরা যেখানেই থাক না কেন”। সুতরাং দরুদ পড়াই যথেষ্ট।[সমাপ্ত]

ইবনে রুশদ রচিত ‘আল-জামে লিল বায়ান’ নামক গ্রন্থে এসেছে- যে বিদেশী আগন্তুক প্রতিদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরে আসেন তার ব্যাপারে ইমাম মালেককে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন: বিষয়টি এমন হওয়া ঠিক নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি হাদিসটি উল্লেখ করেন: “হে আল্লাহ, আপনি আমার কবরকে পৌত্তলিকতার স্থলে পরিণত করবেন না; যেখানে পূজা হয়”[আলবানী ‘তাহযিরুস সাজিদ মিন ইত্তিখাযিল কুবুরি মাসাজিদ’ গ্রন্থে (২৪-২৬) হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]

ইবনে রুশদ বলেন: অতএব, বারবার কবরে গিয়ে সালাম দেয়া, প্রতিদিন কবরে আসা মাকরুহ; যাতে করে কবর মসজিদের মত হয়ে না যায়; যেখানে নামাযের জন্য প্রতিদিন আসা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ বাণীতে এ ব্যাপারে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন: “হে আল্লাহ, আমার কবরকে পৌত্তলিকতার স্থলে পরিণত করবেন না”[দেখুন: ইবনে রুশদ এর ‘আল-বায়ান ওয়াত তাহসীল’ (১৮/৪৪৪-৪৪৫), সমাপ্ত]

কাযী ইয়াযকে মদিনাবাসী এমন কিছু মানুষ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় যারা প্রতিদিন কবরের সামনে একবার বা একাধিকবার দণ্ডায়মান হয়, সালাম দেয় ও কিছু সময় দোয়া করে তখন তিনি বলেন: কোন ফকীহ এমন কোন মত দিয়েছেল বলে আমার কাছে তথ্য নেই। এ উম্মতের শেষ প্রজন্ম সেসব আমলের মাধ্যমে নেককার হবে যেসব আমলের মাধ্যমে প্রথম প্রজন্ম নেককার হয়েছিল। আমার কাছে এ উম্মতের প্রথম প্রজন্মের ব্যাপারে এমন কোন তথ্য পৌঁছেনি যে, তারা এটি করতেন।”[‘আল-শিফা বি তারিফি হুকুকিল মোস্তফা’ (২/৬৭৬)]

সপ্তম:

মসজিদের সকল দিক থেকে কবরের অভিমুখি হওয়া কিংবা যখনি মসজিদে প্রবেশ করবে তখনি কবরের দিকে মুখ করা কিংবা যখনি নামায শেষ করবে তখনি কবরের দিকে মুখ করা। সালাম দেয়ার সময় দুইহাত দুইপাশে রেখে মাথা ও থুতনি নোয়ানো। এগুলো বহুল প্রসারিত বিদাত ও ভুল।

আল্লাহর বান্দারা, আল্লাহকে ভয় করুন। সকল বিদাত থেকে সাবধান হোন। কুপ্রবৃত্তি ও অন্ধ অনুকরণ পরিহার করুন। দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে আমল করুন। আল্লাহ তাআলা বলেন: “যে ব্যক্তি তার রব প্রেরিত সুস্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত, সে কি তার ন্যায় যার কাছে নিজের মন্দ কাজগুলো শোভন করে দেয়া হয়েছে এবং যারা নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করেছে?”[সূরা মুহাম্মদ, আয়াত: ১৪]

আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদেরকে রাসূলের সুন্নাহ অনুযায়ী অন্যদেরকে পথ দেখাবার তাওফিক দেন।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব