শুক্রবার 21 জুমাদাল আউওয়াল 1446 - 22 নভেম্বর 2024
বাংলা

শাবান মাসের দ্বিতীয় অর্ধাংশে রোযা রাখার উপর নিষেধাজ্ঞা

প্রশ্ন

শাবান মাসের অর্ধেকের পর রোযা রাখা কি জায়েয? কারণ আমি শুনেছি যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাবান মাসের অর্ধের পর রোযা রাখতে বারণ করেছেন?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: “যখন শাবান মাসের অর্ধেক গত হবে তখন তোমরা আর রোযা রাখবে না।”[সুনানে আবু দাউদ (৩২৩৭), সুনানে তিরমিযি (৭৩৮), সুনানে ইবনে মাজাহ (১৬৫১) এবং আলবানী ‘সহিহুত তিরমিযি’ গ্রন্থে (৫৯০) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

এ হাদিসটি প্রমাণ করছে যে, শাবান মাসের অর্ধেক গত হওয়ার পর রোযা রাখা নিষিদ্ধ। অর্থাৎ ১৬ তারিখ থেকে।

কিন্তু অন্য কিছু হাদিসে এ দিনগুলোতেও রোযা রাখা জায়েয হওয়ার কথা এসেছে। যেমন:

 আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমরা রমযানের একদিন বা দুইদিন আগে রোযা রাখবে না। তবে কারো যদি রোযা থাকার অভ্যাস থেকে থাকে সে ব্যক্তি রোযা রাখতে পারে।”।[সহিহ বুখারী (১৯১৪) ও সহিহ মুসলিম (১০৮২)]

এ হাদিস প্রমাণ করে যে, যে ব্যক্তির রোযা থাকার অভ্যাস রয়েছে সে ব্যক্তির জন্য অর্ধেক শাবানের পরেও রোযা রাখা জায়েয। যেমন যে ব্যক্তি প্রতি সোমবার ও বৃহষ্পতিবার রোযা থাকে। কিংবা যে ব্যক্তি নিয়মিত একদিন রোযা রাখে, একদিন রাখে না ... এ ধরণের।

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোটা শাবান মাস রোযা রাখতেন। গোটা শাবান মাসের কিয়দংশ ছাড়া গোটা মাস রোযা রাখতেন।[সহিহ বুখারী (১৯৭০) ও সহিহ মুসলিম (১১৫৬), ভাষ্য মুসলিমের]

ইমাম নববী বলেন: আয়েশা (রাঃ) এর উক্তি “রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোটা শাবান মাস রোযা রাখতেন। গোটা শাবান মাসের কিয়দংশ ছাড়া গোটা মাস রোযা রাখতেন”-র দ্বিতীয় বাক্যটি প্রথম বাক্যের ব্যাখ্যা। গোটা মাসের ব্যাখ্যা হচ্ছে- মাসের অধিকাংশ সময়। [সমাপ্ত]

এ হাদিস প্রমাণ করে যে, শাবান মাসের অর্ধেক গত হওয়ার পর রোযা রাখা বৈধ। কিন্তু যে ব্যক্তি আগের অর্ধেকের সাথে পরের অর্ধেক মিলিয়ে রোযা রাখবে তার জন্য।

শাফেয়ি মাযহাবের আলেমগণ এ সবগুলো হাদিসের উপর আমল করেছেন। তারা বলেন:

শাবান মাসের দ্বিতীয় অর্ধেকে রোযা রাখা শুধু তাদের জন্য বৈধ হবে যাদের রোযা রাখার বিশেষ কোন অভ্যাস আছে কিংবা তারা প্রথম অর্ধেক থেকে রোযা রেখে আসছে।

তাদের অধিকাংশ আলেমের মতে, বিশুদ্ধ মত হচ্ছে- হাদিসে নিষেধাজ্ঞাটি হারাম বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।

তাদের কোন কোন আলেমের মতে, -যেমন রুয়ানি- এখানে নিষেধাজ্ঞাটি মাকরুহ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে; হারাম অর্থে নয়।

[দেখুন: আল-মাজমু (৬/৩৯৯-৪০০), ফাতহুল বারী (৪/১২৯)]

ইমাম নববী ‘রিয়াদুস সালেহীন’ (পৃষ্ঠা-৪১২) গ্রন্থে বলেন:

“পরিচ্ছেদ: অর্ধ শাবানের পর রমযানের একদিন আগে রোযা পালন করার উপর নিষেধাজ্ঞা; তবে যে ব্যক্তি এর আগে থেকে লাগাতার রোযা রেখে আসছে কিংবা যে ব্যক্তির অভ্যাসগত রোযা এতে পড়ে যায়, যেমন যার অভ্যাস হচ্ছে- সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা পালন করা­­­­ তারা ঐ দিনসমূহে রোযা পালন করতে পারবে।”[সমাপ্ত]

সংখ্যা গরিষ্ঠ আলেমের মতে, অর্ধ শাবানের পর রোযা রাখা নিষিদ্ধ হওয়া সংক্রান্ত হাদিস দুর্বল। এর ভিত্তিতে তারা বলেছেন: অর্ধ শাবানের পর রোযা রাখা মাকরুহ নয়।

হাফেয ইবনে হাজার বলেন:

সংখ্যা গরিষ্ঠ আলেমের মতে, অর্ধ শাবানের পর নফল রোযা রাখা জায়েয। তারা এ ব্যাপারে বর্ণিত হাদিসকে দুর্বল বলেন। ইমাম আহমাদ ও ইবনে মাঈন বলেছেন: হাদিসটি মুনকার।[ফাতহুল বারী থেকে সমাপ্ত] আরও যারা হাদিসটিকে দুর্বল বলেছেন: বাইহাকী ও তাহাবী।

ইবনে কুদামা ‘আল-মুগনী’ গ্রন্থে বলেন: ইমাম আহমাদ এই হাদিস সম্পর্কে বলেছেন: হাদিসটি সংরক্ষিত নয়; আমরা এ হাদিস সম্পর্কে আব্দুর রহমান বিন মাহদিকে জিজ্ঞেস করেছি: তিনি হাদিসটিকে সহিহ বলেননি এবং আমাদের নিকট হাদিসটি রেওয়ায়েত করেননি। তিনি এ হাদিসটি এড়িয়ে যেতেন। আহমাদ বলেন: আলা একজন নির্ভরযোগ্য রাবী (বর্ণনাকারী); এ হাদিসটি ছাড়া তার অন্য কোন হাদিস মুনকার নয়।”[সমাপ্ত]

আলা হচ্ছেন- আলা বিন আব্দুর রহমান। তিনি এ হাদিসটি তার পিতা থেকে তিনি আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন।

ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) তাহযিবুস্‌ সুনান গ্রন্থে এ হাদিসকে যারা দুর্বল বলেছেন তাদের প্রত্যুত্তর দিয়েছেন। তার বক্তব্যের সারাংশ হল: এ হাদিসটি ইমাম মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ সহিহ হাদিস। এ হাদিসটি আলা এককভাবে বর্ণনা করলেও তাতে দোষের কিছু নেই। যেহেতু আলা একজন ছিকাহ (নির্ভরযোগ্য) রাবী। ইমাম মুসলিম তাঁর সহিহ গ্রন্থে আলা-র সূত্রে তার পিতা থেকে তিনি আবু হুরায়রা (রাঃ) কয়েকটি হাদিস সংকলন করেছেন। এমন অনেক হাদিস রয়েছে যেগুলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে নির্ভরযোগ্য রাবীগণ এককভাবে বর্ণনা করেছেন এবং মুসলিম উম্মাহ সে হাদিসগুলো গ্রহণ করেছে ও সেগুলোর উপর আমল করেছে...। এরপর তিনি বলেন:

আর এ হাদিসটি শাবান মাসে রোযা রাখার প্রমাণবহনকারী হাদিসগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার প্রসঙ্গে কথা হল: এ হাদিসদ্বয়ের মাঝে কোন সংঘর্ষ নেই। কারণ ঐ হাদিসগুলো শাবানের প্রথম অর্ধের সাথে মিলিয়ে দ্বিতীয় অর্ধের রোযা রাখার প্রমাণ বহন করে এবং ব্যক্তির অভ্যাসগত রোযা দ্বিতীয় অর্ধে রাখার প্রমাণ বহন করে। আর আলা-র হাদিস কোন অভ্যাস ব্যতিরেকে কিংবা প্রথম অর্ধের সাথে না মিলিয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে দ্বিতীয় অর্ধে রোযা রাখা নিষিদ্ধ হওয়ার প্রমাণ বহন করে।[সমাপ্ত]

শাইখ বিন বায (রহঃ) শাবান মাসের অর্ধাংশ গত হওয়ার পর রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন: এটি সহিহ হাদিস; যেমনটি প্রিয় ভাই আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলাবানী বলেছেন। আর হাদিসের উদ্দেশ্য হচ্ছে- মাসের অর্ধেক শেষ হওয়ার পর নতুন করে রোযা রাখা শুরু করা। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি অধিকাংশ মাস রোযা রেখেছে কিংবা গোটা মাস রোযা রেখেছে সে ব্যক্তি সুন্নতেরই অনুসরণ করেছে।[মাজমুউ ফাতাওয়াস শাইখ (১৫/৩৮৫) থেকে সমাপ্ত]

শাইখ উছাইমীন (রহঃ) রিয়াদুস সালেহীন এর ব্যাখ্যায় (৩/৩৯৪) বলেন:

এমনকি হাদিসটি যদি সহিহ সাব্যস্ত হয় তবুও হাদিসের নিষেধাজ্ঞা হারাম অর্থে নয়। বরং শুধু মাকরুহ অর্থে। কোন কোন আলেম হাদিসটির এই অর্থই গ্রহণ করেছেন। তবে, কারো যদি রোযা রাখার বিশেষ অভ্যাস থাকে তাহলে সে ব্যক্তি অর্থ শাবানের পরে হলেও রোযা রাখতে পারেন।[সমাপ্ত]

উত্তরের সারাংশ:

অর্ধ শাবানের পর রোযা রাখা হারাম হিসেবে কিংবা মাকরুহ হিসেবে নিষিদ্ধ। তবে যে ব্যক্তির রোযা রাখার বিশেষ কোন অভ্যাস আছে কিংবা যে ব্যক্তি অর্ধ শাবানের আগে থেকে রোযা রেখে আসছে তার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ হবে না। আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।

এই নিষেধাজ্ঞার গূঢ় রহস্য হচ্ছে:

লাগাতার রোযা রাখার মাধ্যমে রমযানের রোযা পালনে দুর্বল হয়ে পড়বে।

যদি কেউ বলে যে, কেউ যদি মাসের শুরু থেকে রোযা রেখে আসে তাহলে তো সে আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়বে?

জবাব হচ্ছে: যে ব্যক্তি শাবান মাসের শুরু থেকেই রোযা রেখে আসছে তার কাছে রোযা রাখাটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। এতে করে রোযা রাখার কষ্ট তার কাছে কম হয়।

আল-ক্বারী বলেন: নিষেধাজ্ঞাটি উম্মতের প্রতি দয়াস্বরূপ তানযিহমূলক; যাতে করে তারা উদ্যমতার সাথে রমযানের রোযা পালন করা থেকে দুর্বল হয়ে না পড়ে। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ শাবান মাস রোযা পালন করবে সে তো রোযা পালনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে বিধায় তার কষ্ট দূর হয়ে যাবে।[সমাপ্ত]

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব