আলহামদু লিল্লাহ।.
এক:
সম্মানিত ভাই, আপনার এমন প্রশ্নের উৎস হচ্ছে প্রসিদ্ধ সে উক্তিটি “আমরা আল্লাহর জাহান্নামের ভয়ে কিংবা তাঁর জান্নাতের লোভে তাঁর ইবাদত করি না। বরং আল্লাহর ভালবাসা থেকে আমরা তাঁর ইবাদত করি! কেউ কেউ এ উক্তিটিকে অন্যভাবে উল্লেখ করে থাকেন। সে উক্তিটির মর্মার্থ হল: যে ব্যক্তি আল্লাহর দোযখের ভয়ে তার ইবাদত করে সেটা হচ্ছে- দাসের ইবাদত। যে ব্যক্তি আল্লাহর জান্নাতের লোভে তাঁর ইবাদত করে সেটা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ইবাদত। তারা দাবী করে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার ভালবাসা থেকে তাঁর ইবাদত করে সে হচ্ছে প্রকৃত আবেদ (ইবাদতগুজার)!!
উক্ত ভাবটি প্রকাশ করার শব্দ বা ভাষা যেটাই হোক না কেন এবং উক্তিকারক যিনিই হন না কেন- এটি ভুল। এটি পবিত্র শরিয়তের সাথে সাংঘর্ষিক। এর প্রমাণ হচ্ছে:
১. প্রিয় ভাই! ভালবাসা, ভয় ও আশা এগুলোর মধ্যে তো কোন সংঘর্ষ নেই যে, আপনাকে শুধু আল্লাহর ভালবাসা থেকে তাঁর ইবাদত করতে হবে। কারণ যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে ও আশা করে আল্লাহর ভালবাসা তার মধ্যে অনুপস্থিত থাকতে হবে; বিষয়টি এমন নয়। বরং হতে পারে সে ব্যক্তি আল্লাহর ভালবাসার দাবীদার অনেকের চেয়ে আল্লাহকে বেশি ভালবাসে।
২. আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকিদা হচ্ছে- শরয়ি ইবাদত: মহব্বত ও সম্মানকে অন্তর্ভুক্ত করে। মহব্বত আশা তৈরী করে; আর সম্মান ভয় তৈরী করে।
শাইখ মুহাম্মদ বিন ছালেহ উছাইমীন (রহঃ) বলেন:
ইবাদত দুইটি মহান বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত: ভালবাসা ও সম্মান। আর এ দুইটি থেকে তৈরী হয়: “তারা সৎকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ত, আর তারা আগ্রহ ও ভীতির সাথে আমাকে ডাকত এবং তারা ছিল আমার কাছে ভীত-অবনত।”[সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৯০] সুতরাং ভালবাসার মাধ্যমে আগ্রহ তৈরী হয় এবং সম্মানের মাধ্যমে ভয়-ভীতি তৈরী হয়। এ কারণেই তো ইবাদত হচ্ছে- কতগুলো আদেশ ও নিষেধ। নির্দেশগুলোর ভিত্তি হচ্ছে- আগ্রহের উপর এবং নির্দেশকারীর কাছে পৌছার অভিপ্রায়ের উপর। আর নিষেধগুলোর ভিত্তি হচ্ছে- সম্মান করা ও এ সম্মানিত সত্তাকে ভয় করার উপর।
যদি আপনি আল্লাহকে ভালবাসেন তাহলে তাঁর কাছে যা আছে সেটা পাওয়ার জন্য ও তাঁর কাছে পৌঁছার জন্য আপনি আগ্রাহী হবেন, তাঁর কাছে পৌঁছার রাস্তা সন্ধান করবেন এবং পরিপূর্ণভাবে তাঁর আনুগত্য পালন করবেন।
আর যদি আপনি আল্লাহকে সম্মান করেন: তাহলে আপনি তাঁকে ভয় করবেন, যখনি কোন গুনাহ করার আকাঙ্ক্ষা মনে জাগবে আপনি স্রষ্টার মহত্ত্ব অনুভব করে সে গুনাহ থেকে বিরত থাকবেন। “নিশ্চয় মহিলা তাকে আকাঙ্ক্ষা করেছিল এবং তিনিও মহিলাকে আকাঙ্ক্ষা করতেন; যদি না তিনিও স্বীয় রবের নিদর্শন দেখতে পেতেন।”[সূরা ইউসূফ, আয়াত: ২৪] সুতরাং আপনি যদি কোন পাপকাজ করার মনস্থ করেন এবং আল্লাহকে আপনার সামনে ভেবে ভয় পেয়ে যান, ভীত হয়ে পড়েন ও পাপ থেকে দূরে সরে আসেন তাহলে এটি আপনার প্রতি আল্লাহর নেয়ামত। যেহেতু আপনি আগ্রহ ও ভয় দুটোর মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করতে পারলেন।[শাইখ উছাইমীনের ফতোয়াসমগ্র (৮/১৭, ১৮)]
৩. নবীগণ, আলেমসমাজ ও তাকওয়াবান লোকেরা ভয় ও আশা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করেছেন এবং তাদের ইবাদতের মধ্যে আল্লাহর ভালবাসাও থাকে। সুতরাং যে ব্যক্তি এ তিনটির কোন একটিকে ধারণ করে আল্লাহর ইবাদত করবে সে বিদআতী; এ অবস্থা তাকে কুফুরীর দিকেও নিয়ে যেতে পারে। ফেরেশতা, নবী ও নেককার লোকদের দোয়াকালীন অবস্থা উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন: “তারা যাদেরকে ডাকে তারাই তো তাদের রবের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে কত নিকটতর হতে পারে, আর তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে।”[সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ৫৭] আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: “তারা সৎকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ত, আর তারা আগ্রহ ও ভীতির সাথে আমাকে ডাকত এবং তারা ছিল আমার কাছে ভীত-অবনত।”[সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৯০]
ইবনে জারীর তাবারী বলেন: “আগ্রহ” এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- তারা তাঁর ইবাদত করত তাঁর রহমত ও অনুগ্রহ পাওয়ার আশা আগ্রহ নিয়ে। “ভীতির সাথে” অর্থাৎ তাঁর ইবাদত বর্জন ও নিষেধ লঙ্ঘন করত না তাঁর শাস্তির ভয়ে। আমরা যে তাফসির করেছি এ তাফসির অপরাপর তাফসিরকারকগণ উল্লেখ করেছেন।[তাফসিরে তাবারী (১৮/৫২১)]
ইবনে কাছির বলেন: “তারা সৎকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ত” অর্থাৎ নেককাজ ও ভালকাজে।
“আর তারা আগ্রহ ও ভীতির সাথে আমাকে ডাকত”। ছাওরী বলেন: অর্থাৎ আমার কাছে যা আছে সেটা পাওয়ার আগ্রহ নিয়ে এবং আমার কাছে আরও যা আছে সেটাকে ভয় করে।
“তারা ছিল আমার কাছে ভীত-অবনত”। ইবনে আব্বাস থেকে আলী বিন আবু তালহা বর্ণনা করেন যে: অর্থাৎ আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সেটার উপর বিশ্বাস রেখে। মুজাহিদ বলেন: প্রকৃত ঈমানদার হয়ে। আবুল আলিয়া বলেন: ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে। আবু সিনান বলেন: অন্তরের অনিবার্য ভয়কে বলা হয়- খুশু; যে ভয় কখনো অন্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। মুজাহিদ থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, অর্থাৎ বিনীত হয়ে। হাসান, কাতাদা ও আল-দাহহাক বলেন: আল্লাহর প্রতি অবনত হয়ে। উল্লেখিত উক্তিগুলো প্রত্যেকটি একটি অপরটির কাছাকাছি।[তাফসিরে ইবনে কাছির (৫/৩৭০)]
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন:
“এ আলোচনা থেকে ঐ ব্যক্তির কথার অস্পষ্টতা ফুটে উঠে, যিনি বলেন: ‘আমি জান্নাতের লোভে কিংবা জাহান্নামের ভয়ে আপনার ইবাদত করছি না; বরং আমি আপনার দর্শনের লোভে আপনার ইবাদত করছি।’কারণ এ ব্যক্তি ও তার অনুসারীরা ধারণা করছে যে, জান্নাত বলতে শুধু পানাহার, পরিচ্ছেদ, বিয়েসাদী ইত্যাদি মাখলুকাতকে উপভোগ করা বুঝায়। এ বিশ্বাসের কারণে জনৈক পীর আল্লাহর বাণী “তোমাদের মধ্যে কেউ দুনিয়া চায়, আর কেউ আখেরাত চায়” শুনে বলেন: “তোমাদের মধ্যে কেউ আল্লাহকে চায়” সেটার উল্লেখ কোথায়?! এ পীরের এমন উক্তি গলদ। অপর এক পীর আল্লাহ তাআলার বাণী: “নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের জান-মাল জান্নাতের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন” শুনে বলেন: ‘যদি জান্নাতের মূল্য হয় জান ও মাল তাহলে আল্লাহর দিদারের উল্লেখ কোথায়?’!
তাদের এ উক্তিগুলোর কারণ হল- তারা মনে করছেন যে, জান্নাতের নেয়ামতের মধ্যে আল্লাহর দিদার থাকবে না। কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে- সকল নেয়ামতের আধার হচ্ছে- জান্নাত। এর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ নেয়ামত হচ্ছে- আল্লাহর চেহারা দেখা। জান্নাতে এ নেয়ামত পাওয়া যাবে। এর সপক্ষে অনেক সুস্পষ্ট দলিল রয়েছে। অনুরূপভাবে জাহান্নামবাসী তাদের রবকে দেখতে পাবে না। তবে এ উক্তিকার যদি তার কথার মর্মার্থটি বুঝতেন; এ কথার উদ্দেশ্য হচ্ছে- আপনি যদি জাহান্নাম ও জান্নাত সৃষ্টি নাও করতেন তবুও আপনার ইবাদত করা, আপনার নৈকট্য হাছিল করা আবশ্যক হত। এখানে জান্নাত দ্বারা তার উদ্দেশ্য হচ্ছে- যে স্থানে আল্লাহর সৃষ্টিকে ভোগ করা হবে।[মাজমুউল ফাতাওয়া (১০/৬২, ৬৩)]
ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) বলেন: প্রকৃতপক্ষে- জান্নাত শুধুমাত্র গাছগাছালি, ফলফলাদি, খাদ্য ও পানীয়, ডাগরচোখা হুর, নদীঝর্ণা, প্রাসাদ ইত্যাদির নাম নয়। অধিকাংশ মানুষ জান্নাতের ব্যাপারে ভুল করে থাকে। বরং জান্নাত হচ্ছে- সাধারণ ও পরিপূর্ণ নেয়ামতের স্থান। জান্নাতের সবচেয়ে উত্তম নেয়ামত হচ্ছে- আল্লাহ তাআলার চেহারা মুবারক দর্শন, তাঁর বাণী শ্রবণ, তাঁর নৈকট্য ও সন্তুষ্টির মাধ্যমে চক্ষু শীতলকরণ। এ নেয়ামতের সাথে পানাহার ও পোষাকাদির নেয়ামতের তুলনা চলে না। কারো প্রতি‘আল্লাহর সন্তুষ্টি’ এর সর্বনিম্ন পর্যায় জান্নাতের অন্যসব নেয়ামত থেকে অনেক বড়। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “বস্তুতঃ এ সমুদয়ের মাঝে সবচেয়ে বড় হল আল্লাহর সন্তুষ্টি।”[সূরা তাওবা, আয়াত: ৭২] এখানে হ্যাঁ-বোধক বাক্যে رضوان শব্দটিকে ‘নাকেরা’ (অনির্দিষ্ট) আনা হয়েছে। অর্থাৎ বান্দার প্রতি তাঁর যে কোন প্রকারের সন্তুষ্টি সেটি জান্নাতের চেয়েও বড়। কবি বলেন:
আপনার পক্ষ থেকে অল্পই আমাকে তুষ্ট করবে... কিন্তু আপনার অল্পকে অল্প বলা যায় না।
আল্লাহর দিদার এর ব্যাপারে হাদিসে এসেছে- “আল্লাহর শপথ, আল্লাহ তাদেরকে তাঁর চেহারা দর্শনের চেয়ে প্রিয় কিছু দেননি।” অপর এক হাদিসে এসেছে- “যখন তিনি তাদেরকে দেখা দিবেন এবং তারা সরাসরি তাঁর চেহারা দেখতে পাবে। তাঁকে দেখে তারা অন্য যেসব নেয়ামতের মধ্যে আছে সেগুলোর কথা ভুলে যাবে, বেখেয়াল হয়ে যাবে এবং সে সবের দিকে দৃষ্টিও ফেলবে না।”
কোন সন্দেহ নেই বিষয়টি এমনই। মানুষের চিন্তায় ও কল্পনায় যা আসতে পারে এটি এর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম নেয়ামত; বিশেষত যারা আল্লাহর ভালবাসায় অনুরক্ত তারা যখন ভালবাসার সাহচর্যে সফলকাম হবে। কারণ “ব্যক্তি যাকে ভালবাসে তার সাথে থাকবে” । এ বিধানের কোন ব্যতিক্রম নেই; বরং এটি সুনিশ্চিত। আর কোন্ নেয়ামত, স্বাদ, চক্ষুশীতলতা ও সফলতায় সেই সাহচর্যের নেয়ামত, স্বাদ ও চক্ষুশীতলতার চেয়ে বড় হতে পারে! যে সত্তার চেয়ে মহান, পরিপূর্ণ ও সুন্দর আর কিছু নেই তাঁর সাহচর্যের উপরে কি আর কোন চক্ষু শীতলতা আদৌ আছে?
আল্লাহর শপথ! এই জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রাণান্তকর সাধনা করেছেন মাহবুবগণ এবং এই ঝান্ডার লক্ষ্য পানে ছুটে চলেছেন আরেফীনগণ। এটি জান্নাত ও জান্নাতী জীবনের রূহ। এর দ্বারা জান্নাত ধন্য হয়েছে। এর ভিত্তিতে জান্নাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সুতরাং এ কথা কিভাবে বলা যেতে পারে যে, “জান্নাতের আশায় ও জাহান্নামের ভয়ে আল্লাহর ইবাদত করা যাবে না?!
একই রকম কথা জাহান্নামের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য (আল্লাহ আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে হেফাযত করুন)। জাহান্নামীদের শাস্তির মধ্যে রয়েছে- আল্লাহর দিদার থেকে বঞ্ছিত হওয়া, আল্লাহর লাঞ্ছনা, ক্রোধ, অসন্তুষ্টির শিকার হওয়া এবং তাঁর তাদেরকে দূরে তাড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি শাস্তি জাহান্নামের আগুনে তাদের দেহ ও রূহ পোড়ানোর চেয়েও কঠিন। বরং তাদের অন্তকরণে আগুনের দহন তাদের দেহের উপরের দহনকে অবধারিত করে দিয়েছে। তাদের অন্তর থেকেই আগুন তাদের দেহে ছড়িয়েছে।
নবী-রাসূল, সিদ্দিকীন, শুহাদা, সালেহীন প্রত্যেকেই জান্নাত আকাঙ্ক্ষা করতেন এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাইতেন। আল্লাহই আমাদের আশ্রয়। তাঁর উপরই আমরা নির্ভর করছি। কোন শক্তি ও সামর্থ্য নেই আল্লাহ ছাড়া। তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম অভিভাবক।[মাদারিজুল সালেকীন (২/৮০,৮১)]
৫. এ উক্তিটির উদ্দেশ্য হচ্ছে-জান্নাত ও জাহান্নামের সৃষ্টিকে হালকাভাবে দেখা। অথচ আল্লাহ তাআলা নিজেই জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন। জান্নাত ও জাহান্নামের জন্য এর অধিবাসীদেরকে প্রস্তুত করেছেন। জান্নাতের মাধ্যমে জান্নাতবাসীকে ইবাদতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং জাহান্নামের মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টিকূলকে তাঁর অবাধ্যতা থেকে ও কুফরী থেকে ভীতি প্রদর্শন করেছেন।
৬. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই আল্লাহর কাছে জান্নাত চাইতেন এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তাঁর সাহাবীবর্গকে জান্নাত চাওয়া ও জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা শিক্ষা দিতেন। এভাবে আলেমসমাজ ও ইবাদতগুজার ব্যক্তিরা ওয়ারিশসূত্রে এটি পেয়েছেন। এর মধ্যে তারা আল্লাহর মহব্বতের কোন কমতি দেখেননি কিংবা তাদের ইবাদতের মর্যাদাতেও কোন ঘাটতি দেখেননি।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবচেয়ে বেশি দুআ করতেন “হে আল্লাহ! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন, আখেরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচান।”[সহিহ বুখারী (৬০২৬)]
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে বলেন: আপনি নামাযে কি বলেন? তিনি বলেন: আমি তাশাহুদ পড়ি, এরপর আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করি এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি। তবে আমি আপনার চুপিচুপি পাঠ কিংবা মুয়ায (অর্থাৎ ইবনে জাবাল) এর চুপিচুপি পাঠের কিছুই বুঝি না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম বলেন: “আমরাও একই রকম কিছু চুপিসারে পাঠ করি।”[সুনানে আবু দাউদ (৭৯২), সুনানে ইবনে মাজাহ (৩৮৪৭) এবং আলবানি সহিহ ইবনে মাজাহ গ্রন্থ হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]
বারা ইবনে আযেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যখন তুমি বিছানায় আসবে তখন নামাযের মত করে অজু কর। এরপর ডান কাতে শয়ন কর। এরপর বল: হে আল্লাহ! আমি আমার প্রাণ আপনার কাছে সমর্পন করছি। আমার সকল সিদ্ধান্ত আপনার কাছে অর্পন করছি। আগ্রহ ও ভয় নিয়ে আমার পিঠ আপনার কাছে পেশ করছি (আপনার উপর নির্ভর করছি)। আপনি ছাড়া আপনার কাছে আশ্রয় কিংবা আপনার কাছ থেকে মুক্তি দেয়ার কেউ নেই। আমি আপনার নাযিলকৃত কিতাব ও প্রেরিত নবীর উপর ঈমান এনেছি। তুমি যদি এ অবস্থায় মারা যাও তাহলে তুমি ফিতরতের উপর (তথা ইসলামের উপর) মারা গেলে। তাই তোমার সর্বশেষ কথা যেন এ বাক্যগুলো হয়।”[সহিহ বুখারী (৫৯৫২) ও সহিহ মুসলিম (২৭১০)]
শাইখ তক্বী উদ্দিন সুবকী (রহঃ) বলেন:
ইবাদতগুজার ব্যক্তিগণ নানা ধরণের হয়ে থাকে। কেউ আছেন আল্লাহর ইবাদত করেন তাঁর সত্তার কারণে।তিনি যদি জান্নাত-জাহান্নাম সৃষ্টি নাও করতেন তবু তিনিই ইবাদতের হকদার- এ বিশ্বাসের কারণে;? এটি সেই উক্তিকারের উক্তির ভাব যিনি বলেন: ‘আমরা আপনার শাস্তির ভয়ে আপনার ইবাদত করছি না এবং আপনার জান্নাতের লোভেও ইবাদত করছি না। বরং আমরা আপনার ইবাদত করছি আপনি ইবাদত পাওয়ার হকদার হওয়ার কারণে। তা সত্ত্বেও এই উক্তিকারক আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করে ও জাহান্নাম থেকে আশ্রয় পার্থনা করে। কিন্তু কিছু লোক না জেনে মনে করে যে, তিনি এমন কোন দুআ করেন না। এটি অজ্ঞতা। যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করে না এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে না সে সুন্নাহ বিরোধী আমল করে। কারণ জান্নাত প্রার্থনা করা ও জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ। এবং আরেকটি দলিল হচ্ছে- ঐ লোকের কথা যে ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল: সে আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করে ও জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে। এবং আরও বলল যে, আমি আপনার চুপিসারের পাঠ ও মুয়ায (রাঃ) এর চুপিসারে পাঠের কিছুই বুঝি না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: আমরাও চুপিসারে এ বিষয়ক দুআ পড়ি।
পূর্বপর সকলের নেতা তিনি যদি এ কথা বলে থাকেন এরপরও যে ব্যক্তি এর বিপরীত কিছু বিশ্বাস করে সে ব্যক্তি ধোকাবাজ মূর্খ।
আহলে সুন্নাহর আদব হচ্ছে- চারটি; যেগুলো না হলে নয়: রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ। আল্লাহর কাছে দৈন্যতা প্রকাশ। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া এবং মৃত্যু পর্যন্ত এর উপর ধৈর্য ধারণ করা। যেমনটি বলেছেন, সাহল বিন আব্দুল্লাহ আল-তাসাত্তুরি এবং তিনি ঠিকই বলেছেন।[সুবকীর ফতোয়াসমগ্র (২/৫৬০)]
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ):
আল্লাহ তাঁর ওলিদের জন্য যা কিছু প্রস্তুত রেখেছেন সেটা জান্নাতের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর সাক্ষাৎ পাওয়া জান্নাতের নেয়ামত। তাই সৃষ্টিকুলের সর্বোত্তম ব্যক্তি আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করতেন এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাইতেন। যখন তিনি তাঁর জনৈক সাহাবীকে জিজ্ঞেস করলেন সে নামাযে কি বলে? তখন সে বলল: আমি আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করি এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি। আমি আপনার চুপিসারে পাঠ কিংবা মুয়াজের চুপিসারে পাঠের কিছুই জানি না। তখন তিনি বললেন: আমরাও এ রকম কিছুই চুপিসারে পাঠ করি।[মাজমুউল ফাতাওয়া (১০/২৪১)]
৭. যে ব্যক্তি ভয় ও আশা ব্যতীত শুধু ভালবাসা থেকে আল্লাহর ইবাদত করতে চায় তার দ্বীনদারি আশংকাজনক অবস্থায় আছে। সে ব্যক্তি চরম পর্যায়ের বিদাতী। এমনকি সে মুসলিম মিল্লাত থেকেও বেরিয়ে যেতে পারে। বড় বড় ইসলামবিদ্বেষীরা বলত: আমরা ভালবাসা থেকে আল্লাহর ইবাদত করি। যদি এটি আমাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে যায় তবুও!! তাদের কেউ কেউ বিশ্বাস করত নিছক ভালবাসার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। এদিক থেকে এটি ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বিশ্বাসের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন: “ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা বলে, আমরা আল্লাহর সন্তান ও তাঁর প্রিয়জন। আপনি বলুন, তবে তিনি তোমাদেরকে পাপের বিনিময়ে শাস্তি দিবেন কেন? বরং তোমার অন্যান্য সৃষ্ট মানবের অন্তর্ভুক্ত সাধারণ মানুষ। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি প্রদান করেন। নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে, তাতে আল্লাহরই আধিপত্য রয়েছে এবং তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে।”।[সূরা মায়িদা, আয়াত: ১৮]
তকি উদ্দিন সুবকি (রহঃ) বলেন:
পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি শুধু ভালবাসা থেকে আল্লাহর ইবাদত করে তার অজ্ঞতা এর চেয়ে বেশি। সে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর কাছে তার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। এর মাধ্যমে সে দাসত্বের দুর্বলতা, নিকৃষ্টতা ও জিল্লতি থেকে ভালবাসার শীর্ষে উন্নীত হয়েছে। যেন সে নিজের ব্যাপারে নিরাপদ। যেন সে তার রবের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছে যে, সে শুধু ডানপন্থী নয়; বরং মুকাররিবীন (নৈকট্যশীল) এর অন্তর্ভুক্ত। কক্ষনো নয়; বরং সে সর্বনিম্ন স্তরের একজন।
বান্দার কর্তব্য হচ্ছে- আল্লাহর সাথে শিষ্টাচার রক্ষা করা, আল্লাহর সামনে নিজেকে তুচ্ছ, নগন্য ও ছোট মনে করা, আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করা। আল্লাহর প্রতিশোধ থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে না করা। আল্লাহর অনুগ্রহের আশা করা। তাঁর সাহায্য চাওয়া। নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধেও আল্লাহর সাহায্য চাওয়া। অনেক চেষ্টা সাধনা করে ইবাদত করার পরেও এ কথা বলা যে, হে আল্লাহ! আপনার ইবাদত যথাযথভাবে আদায় করতে পারিনি। নিজের দুর্বলতার স্বীকারোক্তি দেয়া। নামাযে যেসব দুর্বলতা হয় সেগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে নামাযগুলোর শেষে ইস্তিগফার করা। শেষ রাতে দীর্ঘসময় ধরে কিয়ামুল লাইল আদায় করার পর এর মধ্যে যেসব ত্রুটি হয়েছে সেগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে ইস্তিগফার করা। আর যে ব্যক্তি আদৌ কিয়ামুল লাইল করেনি তার অবস্থা কেমন হওয়া চাই?! [ফাতাওয়াস সুবকি (২/৫৬০)]
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন:
(وَادْعُوهُ خَوْفًا وَطَمَعًا) (অর্থ- ভয় ও আগ্রহ নিয়ে তাঁকে ডাক) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন: আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন যেন মানুষ সতর্ক থাকে, ভীত থাকে এবং আল্লাহর প্রতি আশাবাদী থাকে। মানুষের মধ্যে ভয় ও আশা যেন একটি পাখির দুটো ডানার মতো। যে ডানাদ্বয় তাকে সরল পথে অবিচল রাখবে। যদি কেউ শুধু একটি ডানার উপর নির্ভর করে তাহলে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আপনি আমার বান্দাদেরকে জানিয়ে দিন যে, আমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু। এবং এটাও জানিয়ে দিন যে, আমার শাস্তি বড় যন্ত্রনাদায়ক।[সূরা হিজর, আয়াত: ৪৯, ৫০][তাফসিরে কুরতুবী, (৭/২২৭)]
প্রিয় ভাই, আপনার অপরিহার্য কর্তব্য হচ্ছে- আপনার ইবাদত বন্দেগীর ক্ষেত্রে নবীগণ ও পূর্ববর্তী নেককারদের পথ অনুসরণ করা। আল্লাহ আপনার উপর যেসব ইবাদত পালন করা ফরজ করেছেন সেগুলো আল্লাহ যেভাবে পালন করা পছন্দ করেন সেভাবে পালন করা। এ ইবাদতগুলো আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাছিল, তিনি আমলকারীদের জন্য যে সওয়াব প্রস্তুত রেখেছেন সে সওয়াবের প্রত্যাশা করা এবং কোন ইবাদত পালন বাদ গেলে কিংবা পালনে কোন ত্রুটি হলে সে জন্য আল্লাহর শাস্তির ভয়ে ভীত থাকা। যে ব্যক্তি দাবী করে যে, সে আল্লাহকে ভালবাসে সে যেন আল্লাহকে দেখায় যে, সে তাঁর নবীর অনুসরণ করে। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর, ফলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দিবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল ও দয়ালু।”[সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১]
আল্লাহই ভাল জানেন।