আলহামদু লিল্লাহ।.
এক:
ফিকাহবিদ আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, খোতবা আরবীতে হওয়াই উত্তম। তবে আরবীতে হওয়া শর্ত কিনা এ ব্যাপারে তারা তিনটি মতে মতভেদ করেছেন।
প্রথম অভিমত: যে ব্যক্তি আরবীতে খোতবা পেশ করতে সক্ষম তার জন্য আরবীতে খোতবা দেওয়া শর্ত। এমনকি শ্রোতারা যদি আরবী ভাষা না জানেন তবুও।
এটি মালেকী মাযহাব ও হাম্বলী মাযহাবের মশহুর অভিমত।
[দেখুন: "আল-ফাওয়াকিহুদ দানী" (১/৩০৬), "কাশ্শাফুল ক্বিনা" (২/৩৪)।
দ্বিতীয় অভিমত: আরবীতে খোতবা দিতে সক্ষম ব্যক্তির জন্য আরবীতে খোতবা দেওয়া শর্ত; তবে শ্রোতাদের সকলে যদি আরবী ভাষা না জানেন তাহলে তিনি তাদের ভাষায় খোতবা দিবেন।
শাফেয়ী মাযহাবের আলেমদের নিকট এটাই সঠিক অভিমত। কিছু কিছু হাম্বলী আলেমও এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
[দেখুন: ইমাম নববীর "আল-মাজমু" (৪/৫২২)]
তৃতীয় অভিমত: খোতবা আরবীতে হওয়া মুস্তাহাব; শর্ত নয়। খতীব আরবীর পরিবর্তে তার নিজের ভাষায় খোতবা দিতে পারেন।
এটি ইমাম আবু হানিফা ও কিছু কিছু শাফেয়ী আলেমের অভিমত।
[দেখুন: "রাদ্দুর মুহতার" (১/৫৪৩), "আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা" (১৯/১৮০)]
এই তৃতীয় অভিমতটিই সঠিক। সমকালীন বেশ কিছু আলেম এ অভিমতটিকে মনোনয়ন করেছেন। যেহেতু খোতবা আরবীতে হওয়া আবশ্যককারী সুষ্পষ্ট কোন দলিল উদ্ধৃত হয়নি। আর যেহেতু খোতবার উদ্দেশ্য হচ্ছে— উপদেশ দেওয়া, শিক্ষা ও উপকার হাছিল হওয়া। উপস্থিত লোকদের ভাষায় না হলে তো সেটা অর্জিত হবে না।
রাবেতা আলমে ইসলামীর অধিভুক্ত "ফিকাহ একাডেমী"-র সিদ্ধান্তে যা এসেছে সেটা নিম্নরূপ: "সর্বাধিক ভারসাম্যপূর্ণ অভিমত হচ্ছে— যে সকল দেশের মানুষ আরবীতে কথা বলে না সেসব দেশে জুমার খোতবা ও দুই ঈদের খোতবা সহিহ হওয়ার জন্য আরবী ভাষায় হওয়া শর্ত নয়। তবে, ভাল হয় খোতবার ভূমিকা ও খোতবাতে অন্তর্ভুক্ত আয়াতসমূহ আরবীতে পেশ করা; যাতে করে অনারবদেরকে আরবী ভাষা শুনতে ও কুরআন শুনতে অভ্যস্ত করা যায়। এটি আরবী শেখা এবং যে ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে সে ভাষায় কুরআন পড়াকে সহজ করবে। এরপর খতীব তারা (শ্রোতারা) যে ভাষা বুঝে সে ভাষায় তাদেরকে উপদেশ দিবেন।"[সমাপ্ত][কারারাতুল মাজমায়িল ফিকহি (পৃষ্ঠা-৯৯) (পঞ্চম অধিবেশন, পঞ্চম সিদ্ধান্ত)]
ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির আলেমগণ বলেন:
"নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এমন কোন হাদিস সাব্যস্ত হয়নি যা প্রমাণ করে যে, জুমার খোতবা আরবীতে হওয়া শর্ত। বরঞ্চ তিনি জুমার খোতবা ও অন্যান্য খোতবা আরবী ভাষায় দিতেন যেহেতু তাঁর নিজের ভাষা আরবী এবং তাঁর সমাজের লোকদের ভাষাও আরবী ছিল। তাই তারা যে ভাষা বুঝে তিনি সে ভাষায় তাদের মাঝে খোতবা দিতেন, দিকনির্দেশনা প্রদান করতেন ও তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতেন। কিন্তু তিনি রাজাবাদশাদের কাছেও আরবী ভাষায় চিঠিপত্র পাঠিয়েছেন। তিনি জানতেন যে, তাদের ভাষা আরবী নয়। তিনি এটাও জানতেন যে, তারা তাদের ভাষায় অনুবাদ করিয়ে চিঠির মর্ম বুঝে নিবে।
এর আলোকে যে সকল দেশের অধিবাসীরা আরবী জানে না কিংবা বেশীর ভাগ মানুষ আরবী জানে না সেখানকার জুমার খতীবের জন্য আরবীতে খোতবা (ভাষণ) দেওয়া জায়েয। এরপর সে খোতবা স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ পেশ করবেন; যাতে করে লোকেরা কী উপদেশ ও নসীহত করা হল সেটা বুঝতে পারে এবং উপকৃত হতে পারে।
খতীবের জন্য জুমার খোতবা স্থানীয় অনারবী ভাষায় পেশ করাও বৈধ। এভাবে খোতবা দিলে দিকনির্দেশনা প্রদান, শিক্ষাদান, উপদেশ প্রদান ও নসীহত করা সম্পন্ন হয়, খোতবার উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়।
তবে আরবীতে খোতবা দিয়ে সেটা শ্রোতাদের ভাষায় অনুবাদ করাটা উত্তম। এতে করে খোতবা প্রদান ও চিঠিপত্র প্রদানের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ অটুট রাখা এবং খোতবার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা উভয়টার মাঝে সমন্বয় সাধিত হয়। তাছাড়া এ সংক্রান্ত আলেমদের মতভেদের ঊর্ধ্বে থাকা যায়।"[সমাপ্ত][ফাতাওয়াল লাজনাদ দায়িমা (৮/২৫৩)]
শাইখ বিন বায (রহঃ) বলেন:
"খুব সম্ভব অধিক নিকটবর্তী অভিমত হচ্ছে (সঠিক ইলম আল্লাহ্র কাছে) এ মাসয়ালায় অবস্থাভেদে ভিন্ন ভিন্ন অভিমত দেওয়া। বলা হবে: যদি মসজিদের অধিকাংশ উপস্থিতি অনারব হয়; যারা আরবী বুঝে না; তাহলে অনারবী ভাষায় খোতবা দিতে কোন আপত্তি নেই। কিংবা আরবী ভাষায় খোতবা দিয়ে পরে এর অনুবাদ পেশ করা।
আর যদি অধিকাংশ উপস্থিতি আরবী ভাষা বুঝেন এবং মোটামুটি ভাবটুকু তারা আয়ত্ব করতে পারেন তাহলে উত্তম হচ্ছে আরবী ভাষায় খোতবা দেওয়া এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের বরখেলাফ না করা। বিশেষতঃ সালাফগণ এমন সব মসজিদে খোতবা দিতেন যেখানে অনারবরা থাকত। কিন্তু এমন কোন উদ্ধৃতি নাই যে, তারা খোতবা অনুবাদ করতেন। কেননা তখন আধিপত্য ছিল ইসলামের এবং নেতৃত্ব ছিল আরবী ভাষার।
আর অন্য ভাষায় খোতবা দেওয়া জায়েয হওয়ার পক্ষে শরিয়তে একটি দলিল রয়েছে। তা হল আল্লাহ্র বাণী: "আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার স্বজাতির ভাষা নিয়ে (ভাষাভাষী করে) পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে (আল্লাহ্র বার্তা) বুঝিয়ে বলতে পারে।"[সূরা ইব্রাহিম, আয়াত: ৪]
এ মর্মে আরেকটি দলিল হল সাহাবায়ে কেরাম যখন পারস্য, রোম ইত্যাদি অনারব দেশে অভিযান পরিচালনা করেছেন তখন তারা অনুবাদকদের মাধ্যমে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার আগে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেননি।"[মাজমুউ ফাতওয়া বিন বায (১২/৩৭২)]
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন:
"এ মাসয়ালায় সঠিক অভিমত হচ্ছে উপস্থিত মুসল্লিগণ যে ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা বুঝে না খতীবের জন্য সে ভাষাতে খোতবা দেওয়া জায়েয। যদি উপস্থিত লোকজন আরব না হয় এবং আরবী ভাষা না জানে তাহলে খতীব তাদের ভাষাতে খোতবা দিবেন। কেননা এটাই হচ্ছে তাদেরকে বুঝানোর মাধ্যম। খোতবার উদ্দেশ্য হচ্ছে বান্দাদের কাছে আল্লাহ্র সীমারেখাগুলোর বিবরণ দেওয়া, তাদেরকে উপদেশ দেওয়া, দিকনির্দেশনা দেওয়া। তবে কুরআনের আয়াতগুলো আরবীতে বলা আবশ্যকীয়। এরপর উপস্থিত লোকদের ভাষায় তাফসীর করা। খোতবা স্থানীয় ভাষায় হওয়ার দলিল হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী: "আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার স্বজাতির ভাষা নিয়ে (ভাষাভাষী করে) পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে (আল্লাহ্র বার্তা) বুঝিয়ে বলতে বোঝাতে পারে।"[সূরা ইব্রাহিম, আয়াত: ৪]
আল্লাহ্ তাআলা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, বিবরণ হতে হবে সম্বোধিতরা যে ভাষা বুঝে সে ভাষায়। এর আলোকে খতীব অনারবী ভাষায় খোতবা দিতে পারেন। তবে যখন কোন আয়াত তেলাওয়াত করবেন তখন অবশ্যই আরবী ভাষায় করবেন; যে ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে। এরপর উপস্থিতি লোকদের ভাষায় তাফসীর করবেন।"[সমাপ্ত][ফাতাওয়া নুরুন আলাদ দারব (ফাতাওয়াস সালাত/সালাতুল জুমুআ)]
দেখুন: 984 নং প্রশ্নোত্তর।
দুই:
জুমার নামাযের কাঠামোই পরিবর্তন হয়ে যাওয়া উচিত নয়; যেমনটি প্রশ্নে উল্লেখ করা হয়েছে; তথা দুটো খোতবা প্রদান করা। একটি খোতবা স্থানীয় ভাষায় আযানের আগে। আরেকটি খোতবা আরবী ভাষায় আযানের পরে। বরং উচিত হচ্ছে হয়তো স্থানীয় ভাষায় খোতবা দিবেন। কিংবা আরবী ভাষায় খোতবা দিবেন এবং সাথে সাথে খতীব মিম্বর থেকেই অনুবাদ করে দিবেন।
যারা আরবী ভাষা জানেন না তাদের সৌজন্যে মসজিদে হারামের জুমার খোতবা বিভিন্ন বিদেশী ভাষায় অনুবাদ করা সম্পর্কে শাইখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বলেন: "উল্লেখিত বিষয়ে আমরা একমত পোষণ করি না। জুমার নামাযের আগে বা পরে খোতবা দেওয়া যায় না। যদি উদ্দেশ্য হয় যারা আরবী ভাষা বুঝে না তাদের কাছে খোতবার মর্ম পোঁছানো তাহলে জুমার নামায ব্যতীত অন্য কোন সময় রেডিওর প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে খোতবা অনুবাদ করা যেতে পারে।"[সমাপ্ত][মাজমুউ ফাতাওয়াস শাইখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম (৩/২০)]
আমরা সকল মুসলিমকে আরবী ভাষা শেখার প্রতি উদ্বুদ্ধ করছি। যেহেতু এটি কুরআনের ভাষা। এর মাধ্যমে শরিয়তকে বুঝা যাবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের মর্ম অনুধাবন করা যাবে।
শাইখ রশিদ রেযা (রহঃ) বলেন:
"আমরা একাধিকবার ব্যাখ্যা করেছি যে, আরবী ভাষা জানা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ওয়াজিব। কেননা দ্বীন বুঝা, দ্বীনের অনুশাসনগুলো বাস্তবায়ন করা, দ্বীনের ফরযগুলো আদায় করা— এ সবই আরবী ভাষা বুঝার ওপর নির্ভরশীল। এ ভাষা ব্যতীত এগুলোর পালন শুদ্ধ হয় না। জুমার খোতবা আরবীতে হওয়া তাগিদপূর্ণ হওয়ার দিক থেকে ও সাব্যস্ত হওয়ার দিক থেকে অপেক্ষাকৃত নিম্নপর্যায়ের। যদিও জুমার খোতবা সবচেয়ে বড় শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান।
ইসলামের প্রথম যুগে যে সকল অনারব ইসলামে প্রবেশ করত তারা অবিলম্বে আরবী ভাষা শিখত; যাতে করে তারা কুরআন-সুন্নাহ বুঝতে পারে। ভাষাগত বন্ধন ব্যতীত উম্মাহর ঐক্য সাধিত হবে না। সাহাবায়ে কেরাম যে দেশগুলো বিজয় করতেন তারা সেখানে মানুষের উদ্দেশ্যে আরবী ভাষায় খোতবা দিতেন।
যে দেশগুলোতে সাহাবায়ে কেরাম প্রবেশ করতেন কিছুদিন যেতে না যেতেই ইসলামের প্রভাবে অল্প সময়ের মধ্যে সে দেশের ভাষা সাহাবায়ে কেরামের ভাষায় পরিবর্তিত হত; দুনিয়াবী কোন উদ্বুদ্ধকরণ ব্যতীত কিংবা বাধ্যবাধকতার শক্তি আরোপ ব্যতীত। যদি সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টিভঙ্গি এমন হত যে, অনারবদের মধ্যে যারা সাহাবীদের ধর্ম গ্রহণ করে তাদের ভাষার অনুমোদন করা তাহলে সাহাবায়ে কেরাম দেরী না করে ঐসব ভাষা শিখতেন এবং ঐ সব ভাষায় ইসলামের ফরয আমল ও ইবাদতসমূহ পালন করতেন। এভাবে রোমানভাষী রোমানভাষী থেকে যেত। ফার্সিভাষী ফার্সিভাষী থেকে যেত। এমনটাই চলতে থাকত।
আজ আমরা মুসলিম উম্মহর মাঝে ভাষাগত যে ব্যবধান দেখতে পাই সেটা অপ-রাজনীতির সবচেয়ে বড় কুফল। ওসমানী ও ইরান সাম্রাজ্যদ্বয় যদি সর্বস্তরে আরবী ভাষার ব্যবহারকে নিশ্চিত করার চেষ্টা না করে তবে এমন একদিন আসবে যেদিন তারা এর জন্য অনুতপ্ত হবে। ভারতে যে সংস্কার চলছে কিংবা অন্য কোন মুসলিম দেশে যে সংস্কার চলছে আমরা সেটাকে গগণায় ধরি না; যদি না আরবী ভাষা শেখাকে প্রাথমিক শিক্ষার মেরুদণ্ড গণ্য করা হয় এবং আরবীকেই জ্ঞানের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।"[সমাপ্ত][মাজাল্লাতুল বায়ান (৬/৪৯৬)]
চার:
জুমার আগে চার রাকাত সুন্নত: জুমার আগে কোন সুন্নত নেই। বরং জুমার আগে সাধারণ নফল নামায রয়েছে; কোন সংখ্যা নির্ধারণ করা ব্যতীত। ইতিপূর্বে 6653 নং ও 14075 নং প্রশ্নোত্তরে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।