সোমবার 24 জুমাদাল আউওয়াল 1446 - 25 নভেম্বর 2024
বাংলা

ওজু করার পদ্ধতি

প্রশ্ন

আমি আশা করছি, একজন নারী কিভাবে ওজু করবে সে ব্যাপারে আমাকে অবহিত করবেন। আমি আমার স্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রশ্নটি পেশ করছি। আমি আরও আশা করছি- ইংরেজী বর্ণে আয়াতুল কুরসীর আরবী শব্দগুলো কিভাবে পড়তে পারি সে ব্যাপারে আমাকে জানাবেন। আমি সুন্দর সুন্দর আয়াতগুলো শিখতে চাই যেগুলোতে আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আমি একান্তভাবে আশা করছি, আপনারা আমার এ প্রশ্নের জবাব দিবেন। কারণ উত্তরটি জানার জন্য আমার অন্তর ব্যাকুল হয়ে আছে। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদের প্রিয় নবী, তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর সাহাবীবর্গের ওপর দয়া করেন।

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

আমরা আল্লাহর প্রশংসা করছি; যিনি আপনার জন্য হেদায়েতর পথকে সহজ করে দিয়েছেন, আপনার অন্তরকে খুলে দিয়েছেন। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে ও আপনাকে তাঁর আনুগত্যের ওপর অবিচল রাখেন। আপন ধর্মীয় বিষয়গুলো শেখার জন্য আপনার উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা আপনাকে অব্যাহতভাবে ইলম অর্জনের উপদেশ দিচ্ছি; যে ইলমের মাধ্যমে আপনি আপনার ইবাদতকে নির্ভুল করতে পারবেন। আরবী ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী হতে আপনাকে উদ্বুদ্ধ করি; যাতে করে আপনি কুরআন শরীফ পড়তে পারেন ও যথাযথভাবে কুরআন বুঝতে পারেন। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আপনাকে কল্যাণকর ইলম দান করেন।

ওজুর পদ্ধতি:

ওজু করার দুটো পদ্ধতি রয়েছে-

ক. ফরয পদ্ধতি। সেটা হচ্ছে-

১। সমস্ত মুখমণ্ডল একবার ধৌত করা। এর মধ্যে- গড়গড়া কুলি ও নাকে পানি দেয়াও অন্তর্ভুক্ত হবে।

২। কনুই পর্যন্ত হাত একবার ধৌত করা।

৩। সমস্ত মাথা একবার মাসেহ করা। এর মধ্যে কানদ্বয় মাসেহ করাও অন্তর্ভুক্ত হবে।

৪। দুই পায়ের টাকনু পর্যন্ত একবার ধৌত করা।

পূর্বোক্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘একবার’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- সংশ্লিষ্ট অঙ্গের কোন অংশ যেন ধোয়া থেকে বাদ না পড়ে।

৫। এই ক্রমধারা বজায় রাখা। অর্থাৎ প্রথমে মুখমণ্ডল ধৌত করবে, এরপর হাতদ্বয় ধৌত করবে, এরপর মাথা মাসেহ করবে, এরপর পা দুইটি ধৌত করবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ক্রমধারা বজায় রেখে ওযু করেছেন।

৬। পরম্পরা রক্ষা করা। অর্থাৎ উল্লেখিত অঙ্গগুলো ধৌত করার ক্ষেত্রে পরম্পরা রক্ষা করা; যাতে করে একটি অঙ্গ ধোয়ার পর অপরটি ধোয়ার মাঝখানে স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ সময়ের বিরতি না পড়ে। বরং এক অঙ্গের পরপর অপর অঙ্গ ধারাবাহিকভাবে ধৌত করা।

এগুলো হচ্ছে- ওজুর ফরয কাজ; ওজু শুদ্ধ হওয়ার জন্য যে কাজগুলো অবশ্যই করতে হবে।

এ কাজগুলো ওজুর ফরয হওয়ার পক্ষে দলিল হচ্ছে আল্লাহর বাণী:

“হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্য দাঁড়াতে চাও তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাতগুলো কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নাও এবং তোমাদের মাথায় মাসেহ কর এবং পায়ের টাখনু পর্যন্ত ধুয়ে নাও; এবং যদি তোমরা জুনুবী অবস্থায় থাক, তবে বিশেষভাবে পবিত্র হবে। আর যদি তোমরা অসুস্থ হও বা সফরে থাক বা তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে, বা তোমরা স্ত্রী সহবাস কর এবং পানি না পাও তবে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করবে: তা দ্বারা মুখমণ্ডল ও হাত মাসেহ করবে। আল্লাহ্‌ তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা করতে চান না; বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তাঁর নেয়ামত সম্পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।”[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬]

খ. মুস্তাহাব পদ্ধতি: যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহতে বর্ণিত হয়েছে; ওযুর বিস্তারিত পদ্ধতি নিম্নরূপ:

১। ব্যক্তি নিজে পবিত্রতা অর্জন ও হাদাস (ওজু না থাকার অবস্থা) দূর করার নিয়ত করবে। তবে নিয়ত উচ্চারণ করবে না। কেননা নিয়তের স্থান হচ্ছে- অন্তর। সকল ইবাদতের ক্ষেত্রেই নিয়তের স্থান অন্তর।

২। বিসমিল্লাহ বলবে।

৩। হাতের কব্জিদ্বয় তিনবার ধৌত করবে।

৪। এরপর তিনবার গড়গড়া কুলি করবে (গড়গড়া কুলি: মুখের ভেতরে পানি ঘুরানো)। বাম হাত দিয়ে তিনবার নাকে পানি দিবে ও তিনবার নাক থেকে পানি ঝেড়ে ফেলে দিবে। ‘ইস্তিনশাক’ শব্দের অর্থ- নাকের অভ্যন্তরে পানি প্রবেশ করানো। আর ‘ইস্তিনসার’ শব্দের অর্থ- নাক থেকে পানি বের করে ফেলা।

৫। মুখমণ্ডল তিনবার ধৌত করবে। মুখমণ্ডলের সীমানা হচ্ছে- দৈর্ঘ্যে মাথার স্বাভাবিক চুল গজাবার স্থান থেকে দুই চোয়ালের মিলনস্থল ও থুতনি পর্যন্ত। প্রস্থে ডান কান থেকে বাম কান পর্যন্ত। ব্যক্তি তার দাঁড়ি ধৌত করবে। যদি দাঁড়ি পাতলা হয় তাহলে দাঁড়ির ওপর ও অভ্যন্তর উভয়টা ধৌত করবে। আর যদি দাঁড়ি এত ঘন হয় যে চামড়া দেখা যায় না তাহলে দাঁড়ির ওপরের অংশ ধৌত করবে, আর দাঁড়ি খিলাল করবে।

৬। এরপর দুই হাত কনুই পর্যন্ত তিনবার ধৌত করবে। হাতের সীমানা হচ্ছে- হাতের নখসহ আঙ্গুলের ডগা থেকে বাহুর প্রথমাংশ পর্যন্ত। ওজু করার আগে হাতের মধ্যে আঠা, মাটি, রঙ বা এ জাতীয় এমন কিছু লেগে থাকলে যেগুলো চামড়াতে পানি পৌঁছাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সেগুলো দূর করতে হবে।

৭। অতঃপর নতুন পানি দিয়ে মাথা ও কানদ্বয় একবার মাসেহ করবে; হাত ধোয়ার পর হাতের তালুতে লেগে থাকা অবশিষ্ট পানি দিয়ে নয়। মাসেহ করার পদ্ধতি হচ্ছে- পানিতে ভেজা হাতদ্বয় মাথার সামনে থেকে পেছনের দিকে নিবে; এরপর পুনরায় যেখান থেকে শুরু করেছে সেখানে ফিরিয়ে আনবে। এরপর দুই হাতের তর্জনী আঙ্গুল কানের ছিদ্রতে প্রবেশ করাবে এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কানের পিঠদ্বয় মাসেহ করবে। আর মহিলার মাথার চুল ছেড়ে দেয়া থাকুক কিংবা বাঁধা থাকুক; মাথার সামনের অংশ থেকে ঘাড়ের ওপর যেখানে চুল গজায় সেখান পর্যন্ত মাসেহ করবে। মাথার লম্বা চুল যদি পিঠের ওপর পড়ে থাকে সে চুল মাসেহ করতে হবে না।

৮। এরপর দুই পায়ের কা’ব বা টাকনু পর্যন্ত ধৌত করবে। কা’ব বলা হয় পায়ের গোছার নিম্নাংশের উঁচু হয়ে থাকা হাড্ডিদ্বয়কে। দলিল হচ্ছে ইতিপূর্বে উল্লেখিত উসমান (রাঃ) এর ক্রীতদাস হুমরান এর বর্ণনা যে, একবার উসমান বিন আফফান (রাঃ) ওযুর পানি চাইলেন। এরপর তিনি ওযু করতে আরম্ভ করলেন। (বর্ণনাকারী বলেন), উসমান (রাঃ) হাতের কব্জিদ্বয় তিনবার ধুইলেন, এরপর কুলি করলেন এবং নাক ঝাড়লেন। এরপর তিনবার তার মুখমণ্ডল ধুইলেন এবং ডান হাত কনুই পর্যন্ত তিনবার ধুইলেন। অতঃপর বাম হাত অনুরূপভাবে ধুইলেন। অতঃপর তিনি মাথা মাসেহ করলেন। এরপর তার ডান পা টাখনু পর্যন্ত তিনবার ধুইলেন। অতঃপর অনুরূপভাবে বাম পা ধুইলেন। তারপর বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমার এ ওযুর করার ন্যায় ওযু করতে দেখেছি এবং ওযু শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার এ ওযুর ন্যায় ওযু করবে এবং একান্ত মনোযোগের সাথে দু' রাকাআত সালাত আদায় করবে, সে ব্যক্তির পিছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”[সহিহ মুসলিম, ত্বহারাত ৩৩১]

ওজু শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে- ইসলাম গ্রহণ করা, আকলবান হওয়া, বুঝদার হওয়া ও নিয়ত করা। এসব শর্তের কারণে কোন কাফের ওযু করলে ওযু হবে না। পাগলের ওযু হবে না। বুঝদার হয়নি এমন শিশুর ওযু হবে না। নিয়ত করেনি এমন ব্যক্তির ওযু হবে না; উদাহরণতঃ কেউ যদি ঠাণ্ডা উপভোগ করার নিয়তে এ অঙ্গগুলো ধৌত করে। ওযু শুদ্ধ হওয়ার জন্য পানি পবিত্রকারী হতে হবে। নাপাক পানি দিয়ে ওযু শুদ্ধ হবে না। অনুরূপভাবে ওযু শুদ্ধ হওয়ার জন্য যেসব বস্তু চামড়াতে ও নখে পানি পৌঁছতে বাধা দেয় সেসব জিনিস দূর করতে হবে; যেমন- মহিলাদের নখের মধ্যে ব্যবহৃত নেইল পলিশ।

জমহুর আলেমের মতে, ওযুতে বিসমিল্লাহ পড়ার বিধান রয়েছে। তবে আলেমেরা মতানৈক্য করেছেন— বিসমিল্লাহ পড়া ওয়াজিব নাকি মুস্তাহাব? ওযুর শুরুতে কিংবা মাঝখানে যে ব্যক্তির স্মরণে থাকে তার উচিত বিসমিল্লাহ পড়া।

পুরুষ ও মহিলার ওযু করার পদ্ধতিতে কোন পার্থক্য নেই।

ওযু সমাপ্ত করার পর এই দোয়া বলা মুস্তাহাব: ‘আশহাদু আনলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহ। ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ’। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যখন ওযু করে এবং পরিপূর্ণভাবে পানি পৌঁছায় কিংবা (বলেছেন) পরিপূর্ণভাবে ওযু করে এরপর বলে: ‘আশহাদু আনলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহ। ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ’ (অর্থ- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। তিনি এক। তাঁর কোন শরিক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল) তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজায় খুলে দেয়া হয়। সে দরজা দিয়ে ইচ্ছা সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে”[সহিহ মুসলিম, ত্বহারাত ৩৪৫; সুনানে তিরমিযিতে আরেকটু অতিরিক্ত এসেছে যে, ‘আল্লাহুম্মাজ আলনি মিনাত্তাওয়্যাবীন ওয়াজ আলনি মিনাল মুত্বাতাহ্হিরীন’ (অর্থ- হে আল্লাহ! আমাকে আপনি তওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন, আমাকে পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন)[সহিহুত তিরমিযি গ্রন্থে (৪৮) আলবানী হাদিসটিকে ‘সহিহ’ আখ্যায়িত করেছেন]

[দেখুন শাইখ আল-ফাওযান লিখিত ‘আল-মুলাখ্খাস আল-ফিকহী’ ১/৩৬]

আপনি লিখেছেন “আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন, আমাদের নবীর প্রতি দয়া করেন”: শরয়ি বিধান হচ্ছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে ওপর দরুদ পড়া; ঠিক যেভাবে আমাদের রব্ব আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ্‌ নবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশ্‌তাগণ নবীর জন্য দো’আ-ইসতেগফার করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও নবীর উপর সালাত (দরুদ) পাঠ কর এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।”[সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৬]

সূত্র: শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ