আলহামদু লিল্লাহ।.
এক:
যে রোযার মাধ্যমে আল্লাহ্ দুই বছরের গুনাহ মাফ করেন সেটা আরাফার দিনের রোযা। আর আশুরার রোযার মাধ্যমে আল্লাহ্ এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করেন। আরাফার দিনের রোযার ফযিলত সম্পর্কে জানতে 98334 নং প্রশ্নোত্তর দেখুন। আর আশুরার রোযার ফযিলত সম্পর্কে জানতে 21775 নং প্রশ্নোত্তর দেখুন।
দুই:
নিঃসন্দেহে মদ পান করা কবিরা গুনাহ। বিশেষতঃ পুনঃপুনঃ পান করতে থাকা। কারণ মদ হচ্ছে সকল অশ্লীলতার মূল। এটি সকল অনিষ্টের পথ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদের সাথে সম্পৃক্ত দশ ব্যক্তিকে লানত করেছেন। ইমাম তিরমিযি (১২৯৫) আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদের সাথে সংশ্লিষ্ট দশ ব্যক্তির ওপর লা‘নত করেছেন: যে মদ তৈরি করে, যে মদ তৈরির নির্দেশ দেয়, যে মদ পান করে, যে মদ বহন করে, যার জন্য মদ বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়, যে মদ পান করায়, যে মদ বিক্রি করে, যে মদের আয় ভোগ করে, যে মদ ক্রয় করে, যার জন্য মদ ক্রয় করা হয়।”।[আলবানি ‘সহিহুত তিরমিযি’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]
আপনার আবশ্যকীয় কর্তব্য হচ্ছে- মদ পান বর্জন করা, মদের নেশা থেকে তওবা করে আল্লাহ্র দিকে ফিরে আসা।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন:
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহিহ হাদিসে এসেছে: আরাফার দিনের রোযা দুই বছরের পাপ মোচন করে। আশুরার দিনের রোযা এক বছরের পাপ মোচন করে। কিন্তু ‘পাপ মোচন’ করে এই শর্তবিযুক্ত কথার দ্বারা তওবা ছাড়া কবিরা গুনাহ মাফ হওয়াটা আবশ্যক হয় না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘এক জুমা থেকে অপর জুমা এবং এক রমযান থেকে অপর রমযান’ এর ব্যাপারে বলেছেন: “মাঝের সব গুনাহকে মোচন করে যদি কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকা হয়।” সবার জানা আছে যে, রোযার চেয়ে নামায উত্তম এবং আরাফার রোযার চেয়ে রমযানের রোযা উত্তম; অথচ কবিরা গুনাহ থেকে বিরত না থাকলে এগুলোর মাধ্যমে পাপ মোচন হয় না; যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (এই হাদিসে) শর্ত করে দিয়েছেন। সুতরাং কিভাবে কল্পনা করা যায় যে, এক, দুই দিনের নফল রোযার মাধ্যমে ব্যভিচার, চুরি, মদ পান, জুয়া, যাদু ইত্যাদি গুনাহ মাফ হবে?! অর্থাৎ এ ধরণের গুনাহ মাফ হবে না।”[আল-ফাতাওয়া আল-মিসরিয়্যা (১/২৫৪) সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত]
ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) বলেন:
“কেউ কেউ বলে যে, আশুরার রোযা গোটা বছরের পাপ মোচন করে। আর আরাফার রোযা সওয়াব বৃদ্ধির জন্য অবশিষ্ট থাকল। এই প্রবঞ্চিত লোকটি জানে না যে, রমযানের রোযা ও পাঁচ ওয়াক্ত নামায আরাফার রোযা ও আশুরার রোযার চেয়ে উত্তম ও মহান। অথচ এগুলোর মাধ্যমে কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকার শর্তে পাপ মোচন হয়। তাই এক রমযান থেকে অপর রমযান, এক জুমা থেকে অপর জুমা ‘সগিরা গুনাহ’ মোচন করানোর মত শক্তি পায় না; যদি না এর সাথে কবিরা থেকে বিরত থাকা হয়। বরঞ্চ দুইটি বিষয় একযোগ হওয়ার পর সগিরা গুনাহ মাফ হয়।
তাহলে কিভাবে একদিনের নফল রোযা বান্দা কর্তৃক পুনঃপুনঃ সম্পাদিত সকল কবিরা গুনাহকে তওবা ছাড়া মাফ করাবে? এটি অসম্ভব।
তবে ‘আরাফার রোযা ও আশুরার রোযা সারা বছরের পাপ মোচন করে’ এই সাধারণ অর্থ ধরলে এটি আশ্বাসমূলক দলিলগুলোর অন্তর্ভুক্ত হতে কোন বাধা নেই; যে দলিলগুলোর ক্ষেত্রে শর্ত পাওয়া ও প্রতিবন্ধকতা মুক্ত হওয়া প্রযোজ্য। তখন পুনঃপুনঃ কবিরা গুনাহ-তে লিপ্ত হওয়া গুনাহ মোচনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হবে। আর কবিরা গুনাহ-তে পুনঃপুনঃ লিপ্ত না হলে তখন রোযা ও কবিরা গুনাহ-তে পুনঃপুনঃ লিপ্ত না-হওয়া এ দুটো যৌথ সহযোগিতার ভিত্তিতে সকল গুনাহ মোচন করবে। যেমনিভাবে রমযানের রোযা, পাঁচ ওয়াক্ত নামায এবং কবিরা গুনাহ হতে বিরত থাকা যৌথ সহযোগিতার ভিত্তিতে ছগিরা গুনাহগুলোকে মোচন করে। তবে আল্লাহ্ তাআলা যে বলেছেন, “তোমাদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছে তার মধ্যে যা কবিরা গুনাহ তা থেকে বিরত থাকলে আমরা তোমাদের ছোট পাপগুলো মার্জনা করে দিব।”[সূরা নিসা, আয়াত: ৩১] এর থেকে জানা যায় যে, কোন একটি বিষয়কে পাপ মোচনের কারণ বানানো হলেও অন্য একটি কারণ এই কারণের সাথে একত্রিত হয়ে পাপ মোচনে যৌথ সহযোগিতা করতে কোন বাধা নেই। আর দুইটি কারণ যৌথভাবে একটি কারণের চেয়ে পাপ মোচনের শক্তি বেশি রাখে। ‘কারণ’ যত শক্তিশালী হবে পাপ মোচনের ক্ষমতা তত অধিক হবে।”[আল-জাওয়াব আল-কাফি, পৃষ্ঠা-১৩ থেকে সমাপ্ত]
আব্দুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি মদ পান করে চল্লিশ দিন পর্যন্ত আল্লাহ্ তার নামায কবুল করেন না। সে তওবা করলে আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন। সে যদি পুনরায় তা পান করে তবে আল্লাহ চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার নামায কবুল করবেন না। যদি তওবা করে আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন। আবার যদি সে তা পান করে তবে চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার নামায কবুল করবেন না। কিন্তু সে যদি তওবা করে তবে আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন। চতুর্থবার পুনরায় সে যদি তা পান করে তবে চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার নামায কবুল করবেন না এবং তওবা করলেও আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন না। পরন্তু তাকে ‘নহরে-খাবাল’ (জাহান্নামীদের পূজের নহর) থেকে পান করাবেন।”[সুনানে তিরমিযি (১৮৬২), আলবানি ‘সহিহুত তিরমিযি’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]
মুবারকপুরী ‘তুহফাতুল আহওয়াযি’ গ্রন্থে বলেন:
বিশেষভাবে নামাযকে উল্লেখ করা হয়েছে যেহেতু শারীরিক ইবাদতের মধ্যে নামায সর্বোত্তম ইবাদত। অতএব, নামায যদি কবুল না হয় অন্য ইবাদত কবুল না হওয়া আরও অধিক যুক্তিযুক্ত।[তুহফাতুল আহওয়াযি (৫/৪৮৮) থেকে পরিমার্জিত ও সমাপ্ত]
একই ধরণের কথা ইরাকি ও মুনাওয়িও বলেছেন।
অতএব, পুনঃপুনঃ মদ পান করতে থাকলে যদি ইবাদতগুলো কবুল না হয় তাহলে আশুরার রোযা কিভাবে কবুল হবে?! আর কিভাবে এক বছরের পাপ মোচন করবে?!
আপনার কর্তব্য হচ্ছে- অবিলম্বে খালেস ও বিশ্বস্ত তওবা করা এবং মদ পানের মত জঘন্য যে কাজ করে আসছেন তা ছেড়ে দেয়া এবং আপনি যে কসুরের মধ্যে আছেন সেটার ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা। বেশি বেশি নেকির কাজ করা। আশা করি আল্লাহ্ আপনার তওবা কবুল করবেন, ইতিপূর্বে আপনি যে কসুর করেছেন ও আল্লাহ্র সীমা লঙ্ঘন করেছেন তা এড়িয়ে যাবেন।
তিন:
এতক্ষণ আমরা যা উল্লেখ করেছি এগুলো আরাফার দিন রোযা রাখা, আশুরার দিন রোযা রাখা কিংবা আপনার ইচ্ছানুযায়ী নামায, রোযা, সদকা ও কুরবানি ইত্যাদি অন্য যে কোন নফল আমল করার ক্ষেত্রে কোন বাধা নয়। কারণ মদ পান করা এ সকল ইবাদত পালনে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে না। কবিরা গুনাহ-তে লিপ্ত হওয়ার অর্থ এই নয় যে, আপনি নিজেকে অন্য সকল নেকী ও ভাল কাজ থেকে দূরে রাখবেন; এতে তো অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকবে। বরং আপনি অবিলম্বে তওবা করুন, মদ পান ছেড়ে দিন, বেশি বেশি নেক কাজ করুন; এমনকি কখনও কুপ্রবৃত্তি যদি কোন গুনাহ করার ক্ষেত্রে আপনাকে পরাভূত করে ফেলে তবুও।
কেননা আমল সঠিক হওয়া ও কবুল হওয়া এক জিনিস; আর এক বছর বা দুই বছরের গুনাহ মোচনের বিশেষ মর্যাদা লাভ করা অন্য জিনিস।
জাফর বিন ইউনুস বলেন:
একবার তিনি শামের এক কাফেলার যাত্রী ছিলেন। আরব দস্যুরা কাফেলার উপর হামলা করে কাফেলাকে পাকড়াও করল। দস্যুরা কাফেলাকে দস্যুনেতার কাছে পেশ করল। সে এক থলি বের করল; এর ভিতরে চিনি ও বাদাম ছিল। দস্যুরা সবাই এগুলো খেল। কিন্তু দস্যুনেতা কিছুই খেল না।
আমি বললাম: তুমি খেলে না কেন? সে বলল: আমি রোযাদার!
আমি বললাম: তুমি ডাকাতি কর, সম্পদ ছিনিয়ে নাও, মানুষ হত্যা কর। আবার রোযাও থাক?!
সে বলল: শাইখ, আমি সংশোধনের জন্য কিছু সুযোগ রাখছি!!
একটা সময় পর আমি তাকে ইহরাম অবস্থায় বায়তুল্লাহ্ তাওয়াফ করতে দেখে বললাম: তুমি সেই লোক না?
সে বলল: সেই রোযা আমাকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে!![তারিখু দিমাশক্ (৬৬/৫২)]