আলহামদু লিল্লাহ।.
মুসলিম যদি আল্লাহর বিধানের প্রতি সন্তুষ্ট হয়, এর সামনে নিজেকে সমর্পণ করে, এটাকে প্রত্যাখ্যান না করে এবং এতে আপত্তি না করে, (এটাই তার উপর আবশ্যক) তবে তার মন যদি স্বভাবগতভাবে কোন কাজকে অপছন্দ করে এতে তার ক্ষতি হবে না। যেমন: মন যুদ্ধ করতে অপছন্দ করে, তবে আল্লাহর বিধানকে মেনে নেয়া ও তাঁর বিধানের প্রতি নতি স্বীকার করা। আল্লাহ তাআলা বলেন:
كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
“তোমাদের জন্য যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে, অথচ তোমাদের কাছে সেটি অপছন্দনীয়। তবে এমন হতে পারে যে, তোমরা একটা জিনিস অপছন্দ করো, অথচ সেটা তোমাদের জন্য ভালো; আবার এমনও হতে পারে যে, তোমরা একটা জিনিস পছন্দ করো, অথচ সেটা তোমাদের জন্য খারাপ। আল্লাহ জানেন (প্রকৃতপক্ষে কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ) আর তোমরা জানো না।”[সূরা বাকারা: ২১৬]
অনুরূপ বিষয় হলো: কোন নারী সতীনের উপস্থিতিকে অপছন্দ করা। এটি প্রকৃতিগত বিষয়। কারণ সতীন তার স্বামীকে নিয়ে তার সাথে টানাটানি করবে। কিন্তু আল্লাহর ফরযকৃত যুদ্ধকে অপছন্দ করা, আর কারো মন যুদ্ধকে অপছন্দ করার মাঝে পার্থক্য রয়েছে। অনুরূপভাবে আল্লাহর প্রণীত বহুবিবাহের বিধানকে অপছন্দ করা আর সতীনের উপস্থিতিকে মনে অপছন্দ করা আলাদা বিষয়। আল্লাহ যা ফরয করেছেন এবং শরীয়ত হিসেবে দিয়েছেন সেটিকে দ্বীন এবং আল্লাহর নৈকট্য হিসেবে ভালোবাসতে হবে, যদিও ফরয কাজটি মনের কাছে অপছন্দনীয় এবং কঠিন হয়। তবে বান্দার ঈমান যত পূর্ণ হবে, ততই এই অপছন্দনীয় বিষয়গুলোও প্রকৃতিগতভাবে বান্দার কাছে প্রিয় হয়ে উঠবে যেমনিভাবে শরয়ি দিক থেকেও পছন্দনীয় থাকে।
ইসলাম ভঙ্গকারী বিষয়গুলোর মাঝে উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সেটাকে অপছন্দ করা এবং তাঁর শরীয়তকে অপছন্দ করা।
ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “সন্তুষ্টির শর্ত এই নয় যে কষ্ট-বেদনা অনট-বেদনা রুর তীর্ণ করেছেন তা অফছএকটা জিনিস পুভব না করা। বরং শর্ত হলো আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে আপত্তি না করা এবং এর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ না করা। তাই কিছু মানুষের কাছে অপছন্দনীয় ব্যাপারে সন্তুষ্ট থাকার বিষয়টি জটিল ঠেকেছে এবং তারা এতে আপত্তি করেছেন। তারা বলেছেন: এটা স্বভাবতই অসম্ভব। বরং সেটা ধৈর্য। তা না হলে সন্তুষ্টি ও অপছন্দ কীভাবে একত্রিত হতে পারে? যেহেতু দুটি বিপরীত বিষয়। সঠিক মত হলো: এই দুটির মাঝে কোনো বৈপরিত্য নেই। কষ্ট ও মানসিক অপছন্দের উপস্থিতি সন্তুষ্টিকে নাকচ করে না। যেমন: রোগী অপছন্দনীয় ঔষধ পান করার ব্যাপারে তুষ্ট থাকে। তীব্র গরমের দিনে রোযাদার ক্ষুৎপিপাসার যে বেদনা অনুভব করে তার ব্যাপারে সন্তুষ্ট থাকে। মুজাহিদ আল্লাহর রাস্তায় ক্ষত-বিক্ষত হলে যে ব্যথা পায় তাতে রাজী-খুশি থাকে।”[মাদারিজুস সালিকীন: ২/১৭৫]
শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য বলেন: “আল্লাহ তাআলা বলেন: وَهُوَ كُرۡهٞ لَّكُمۡۖ
এটি তোমাদের জন্য অপছন্দনীয়।) كره (কুরহুন) শব্দটি مصدر তথা ক্রিয়ামূল; তবে এটি اسم المفعول (কর্মবাচক বিশেষ্যের) অর্থে ব্যবহৃত। অর্থাৎ এটি তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। اسم المفعول এর অর্থে مصدر এর ব্যবহার অনেক পাওয়া যায়। যেমন:
وَإِنْ كُنَّ أُولَاتِ حَمْلٍ
“যদি তারা গর্ভ ধারণ করা ওয়ালা হয়।”[সূরা তালাক: ৬] অর্থাৎ গর্ভ ধারণ করা ‘গর্ভে ধারণকৃত’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: من عمل عملاً ليس عليه أمرنا فهو رد (যে ব্যক্তি এমন কাজ করে যা আমাদের শরীয়তে নেই সেটা প্রত্যাখ্যাত করা)।” অর্থাৎ প্রত্যাখ্যান করা ‘প্রত্যাখ্যাত’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ (এটি তোমাদের জন্য অপছন্দনীয়) বাক্যটি حال (ক্রিয়া বিশেষণ) হওয়ার কারণে نصب (নসব) অবস্থায় রয়েছে। সর্বনাম ‘هو’র প্রত্যাবর্তনস্থল (বিশেষ্য) হলো القتال। এর প্রত্যাবর্তনস্থল (নামপদ) الكتابة (ফরয করা) নয়। মুসলিমগণ আল্লাহ তাদের উপর যা আবশ্যক করেছেন সেটাকে অপছন্দ করে না। বরং মানবীয় প্রকৃতিগত কারণে তারা যুদ্ধকে অপছন্দ করে। ‘আল্লাহ যে যুদ্ধ আবশ্যক করেছেন আমরা সেটাকে অপছন্দ করি’ আর ‘আমরা যুদ্ধকে অপছন্দ করি’ এ দুই কথার মধ্যে ফারাক আছে। যুদ্ধকে অপছন্দ করা এটা প্রকৃতিগত বিষয়। মানুষ কারো সাথে লড়াই করে তাকে হত্যা করাকে অপছন্দ করে; যার ফলশ্রুতিতে সেও নিহত হবে। কিন্তু এই যুদ্ধ যদি আমাদের উপর ফরয করা হয়, তখন এটি এক দিক থেকে আমাদের কাছে পছন্দনীয়; অন্য দিক থেকে অপছন্দনীয়। আল্লাহ আমাদের উপর ফরয করেছেন এই দিক থেকে এটি আমাদের কাছে পছন্দনীয়। এ কারণে সাহাবীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে যুদ্ধ করার জন্য পীড়াপীড়ি ব্যক্ত করতেন। আর যেহেতু আমাদের মন যুদ্ধ থেকে দূরে থাকতে চায়, সে দিক থেকে এটি আমাদের কাছে অপছন্দনীয়।”
তারপর তিনি এ আয়াতের শিক্ষায় বলেন: “এই আয়াতের অন্যতম শিক্ষা হলো মানুষের উপর যা আবশ্যক করা হয়েছে সে কাজটি অপছন্দ করা তার জন্য দোষণীয় না। তবে শরীয়তদাতার নির্দেশ হিসেবে নয়; বরং প্রকৃতিগতভাবে সেটি অপছন্দ করতে পারে। আর শরীয়তদাতার নির্দেশের দিক থেকে এর প্রতি তুষ্ট থাকা এবং এ বিধানের ব্যাপারে অন্তর প্রসন্ন রাখা আবশ্যক।”[সমাপ্ত][ইবনে উছাইমীনের তাফসীরুল কুরআন]
অন্য স্থানে তিনি বলেন: ‘আল্লাহর বাণী “এটি তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়” এর ব্যাপারে জানা আবশ্যক যে, এখানে সর্বনাম هو এর উৎস বিশেষ্য হলো القتال (যুদ্ধ); الكتابة (আবশ্যকতা) নয়। কারণ সাহাবীরা আল্লাহর ফরযকৃত বিষয়কে অপছন্দ করতে পারেন না। কিন্তু তারা যুদ্ধকে অপছন্দ করতেন। যুদ্ধে লিপ্ত হলে তারা নিহত হবেন।
‘কেউ আল্লাহর দেয়া বিধানকে অপছন্দ করা’ আর ‘যে বিষয়ে বিধান এসেছে সেটাকে অপছন্দ করা’ এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে।’[সমাপ্ত][মুআল্লাফাতুশ শাইখ ইবনে উছাইমীন: ২/৪৩৮]
সারকথা হলো: মুমিন নারীর জন্য আল্লাহ কর্তৃক আরোপিত বহুবিবাহের বিধানের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা আবশ্যক। তাকে বিশ্বাস করতে হবে যে এতে রয়েছে প্রজ্ঞা ও কল্যাণ। তার উচিত হবে না, এ হুকুম ও বিধানকে অপছন্দ করা; যদিও তার মন তার সাথে ভাগ বসাতে আসা সতীনের উপস্থিতিকে অপছন্দ করে যেমনিভাবে মানুষ যুদ্ধকে অপছন্দ করে। একইভাবে আরাম-আয়েশে বিঘ্ন ঘটায় এমন সব কিছুকেই মানুষ অপছন্দ করে। উদাহরণস্বরূপ: ফজরের নামাযের জন্য ঠাণ্ডা পানি দিয়ে অযু করা, তীব্র গরমের মধ্যে রোযা রাখা প্রভৃতি বিষয়ে কষ্ট রয়েছে। কিন্তু কষ্টকে বান্দা মোকাবিল করেন আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা দিয়ে, তাঁর শরীয়তের প্রতি সন্তুষ্টি ও সমর্পণ দিয়ে। এ কারণে বুখারী (৬৪৮৭) ও মুসলিম (২৮২৩) বর্ণিত হাদীসে রয়েছে: আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “জান্নাতকে অপছন্দনীয় বিষয় দিয়ে বেষ্টিত করা হয়েছে। আর জাহান্নামকে কামনা-বাসনা দ্বারা বেষ্টিত করা হয়েছে।”
ইমাম নববী সহিহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থে বলেন: “অপছন্দনীয় বিষয়াবলির মধ্যে রয়েছে: ইবাদতে শ্রম দেয়া ও নিয়মানুবর্তিতা রক্ষা করা, ইবাদত সম্পাদনের কষ্টে ধৈর্যধারণ করা, রাগকে দমন করা, ক্ষমা, সহিষ্ণুতা, দানশীলতা, মন্দ আচরণকারীর প্রতি সদাচরণ করা, কামনা-বাসনা ত্যাগ করার ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরা প্রভৃতি।”[সমাপ্ত]
অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, তিনি বলেন: “আমি কি তোমাদেরকে এমন কাজ জানাবো না, যা করলে আল্লাহ (বান্দার) পাপরাশি দূর করে দেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন?” লোকরা বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি বলুন। তিনি বললেন: “অপছন্দ সত্ত্বেও পরিপূর্ণরূপে অযু করা, মসজিদের পথে বেশি বেশি কদম ফেলা এবং এক নামাযে পর অন্য নামাযের জন্য অপেক্ষা করা। আর এ কাজগুলোই হলো রিবাত (প্রস্তুতি)।”[হাদীসটি মুসলিম (২৫১) বর্ণনা করেন আবু হুরাইরার সূত্রে]
নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “পরিপূর্ণভাবে অযু করা অপছন্দনীয় হয় তীব্র শীতের কারণে এবং শরীরে ব্যাথ্যা থাকলে কিংবা অনুরূপ কোন বিষয়ের ক্ষেত্রে।”[সমাপ্ত]
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।