বুধবার 2 যুলক্বদ 1446 - 30 এপ্রিল 2025
বাংলা

আযান দেয়ার পদ্ধতি

প্রশ্ন

জামাতের সাথে নামাযের আগে কীভাবে তাকবীর (আযান উদ্দেশ্য) দিতে হবে? কোন কোন শব্দগুলো সে বলবে? আযানে কি সব কিছু দুই বার করে বলবে; নাকি একবার করে? এ বিষয়টি আমার কাছে তালগোল পাকিয়ে আছে।

উত্তরের সংক্ষিপ্তসার

আযানের কয়েকটি ধরন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত। হাদিসে উদ্ধৃত একাধিক ধরনের উপর আমল করা সুন্নত। যাতে করে এর মাধ্যমে সুন্নাহকে পুনরুজ্জীবন করা যায় এবং বাদানুবাদ ও মতভেদকে নির্মূল করা যায়। যে মতভেদ কেউ কেউ অজ্ঞতাবশতঃ কিংবা স্বীয় মাযহাবের পক্ষপাতিত্ব করতে গিয়ে জাগিয়ে তোলে।

আবূ মাহযূরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে এ আযান শিক্ষা দিয়েছেন: “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার” (আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান)। “আশহাদু আল লা-ইলা-হা-ইল্লাল্ল-হ” (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, কোন উপাস্য সত্য নয়; আল্লাহ ছাড়া), আশহাদু আল লা-ইলা-হা ইল্লাল্ল-হ” (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, কোন উপাস্য সত্য নয়; আল্লাহ ছাড়া)। “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসূলুল্লা-হ” (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল), আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসূলুল্লা-হ” (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল)। এরপর তিনি পুনরাবৃত্তি করে আবার বলতেন: “আশহাদু আল লা-ইলা-হা ইল্লাল্ল-হ”, “আশহাদু আল লা-ইলা-হা ইল্লাল্ল-হ”, “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্ল-হ”, “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্ল-হ”। “হাইয়্যা ‘আলাস সালাহ” (সালাতের জন্য আসুন), দুইবার। “হাইয়্যা ‘আলাল ফালা-হ” (কল্যাণের জন্য আসুন), দুইবার। আল্ল-হু আকবার, আল্ল-হু আকবার” এবং “লা-ইলা-হা ইল্লাহ-হ”।

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

আযানের কয়েকটি ধরন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত। হাদিসে উদ্ধৃত একাধিক ধরনের উপর আমল করা সুন্নত। যাতে করে এর মাধ্যমে সুন্নাহকে পুনরুজ্জীবন করা যায় এবং বাদানুবাদ ও মতভেদকে নির্মূল করা যায়। যে মতভেদ কেউ কেউ অজ্ঞতাবশতঃ কিংবা স্বীয় মাযহাবের পক্ষপাতিত্ব করতে গিয়ে জাগিয়ে তোলে।

শাইখ ইবনে উছাইমীন বলেন: ‘সুন্নাহতে আযানের যত রকম বিবরণ এসেছে সবগুলো জায়েয। বরং উচিত হলো, যদি ফিতনা বা ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি না হয় তাহলে কখনো একটি রূপে, আবার কখনো অন্য আরেকটি রূপে আযান দেওয়া।

ইমাম মালেকের মতে আযানের বাক্য সতেরটি। প্রথমে দুই বার তাকবীর বলবে। এরপর সাক্ষ্যদ্বয় (আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ব্যাপারে সাক্ষ্য) মনে মনে বলবে; এটাকে বলা হয় ‘তারজী’। তারপর সাক্ষ্যদ্বয় উচ্চস্বরে বলবে।

ইমাম শাফেয়ীর মতে আযানের বাক্য উনিশটি। শুরুতে তাকবীর চার বার বলতে হবে। এরপর সাক্ষ্যদ্বয় বলার সময় ‘তারজী’ করতে হবে।

এগুলো সবই সুন্নাহতে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং আপনি যদি কখনো এভাবে, আবার কখনো ঐভাবে আযান দেন, তাহলে সেটি উত্তম। মূলনীতি হলো: ‘যে ইবাদতগুলোর নানান ধরন বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে মানুষের করণীয় হলো সবগুলো পদ্ধতিতেই ইবাদত করা।’[আশ-শারহুল মুমতি (২/৫১-৫২)]

আর ইমাম আহমদ ও আবু হানীফার মাযহাব হলো: আযানের বাক্য পনেরটি। কারণ বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর আযান এমন ছিল।

ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেয়ীর দলীল হলো:

আবূ মাহযূরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে এ আযান শিক্ষা দিয়েছেন: “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার” (আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান)। “আশহাদু আল লা-ইলা-হা-ইল্লাল্ল-হ” (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, কোন উপাস্য সত্য নয়; আল্লাহ ছাড়া), আশহাদু আল লা-ইলা-হা ইল্লাল্ল-হ” (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, কোন উপাস্য সত্য নয়; আল্লাহ ছাড়া)। “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসূলুল্লা-হ” (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল), আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসূলুল্লা-হ” (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল)। এরপর তিনি পুনরাবৃত্তি করে আবার বলতেন: “আশহাদু আল লা-ইলা-হা ইল্লাল্ল-হ”, “আশহাদু আল লা-ইলা-হা ইল্লাল্ল-হ”, “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্ল-হ”, “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্ল-হ”। “হাইয়্যা ‘আলাস সালাহ” (সালাতের জন্য আসুন), দুইবার। “হাইয়্যা ‘আলাল ফালা-হ” (কল্যাণের জন্য আসুন), দুইবার। আল্ল-হু আকবার, আল্ল-হু আকবার” এবং “লা-ইলা-হা ইল্লাহ-হ”।[হাদীসটি মুসলিম (৩৭৯) বর্ণনা করেন]

এই হাদীসটি মালেক ও শাফেয়ীর মাযহাবের দলীল। কারণ হাদীসটির শুরুতে তাকবীর দুইভাবে বর্ণিত হয়েছে: দুইবার, যেমনটি মালেকের মাযহাব, আর চারবার যেমনটি শাফেয়ীর মাযহাব।

ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: অধিকাংশ মূল পাণ্ডুলিপিতে সহীহ মুসলিমের এই হাদীসটিতে আল্লাহু আকবর মাত্র দুই বার রয়েছে। কিন্তু মুসলিম ছাড়া অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’ চারবার উল্লেখ করা হয়েছে। কাযী ইয়ায রাহিমাহুল্লাহ বলেন: সহীহ মুসলিমের ফারেসীর কিছু সূত্রে চারবার বলা হয়েছে। ... চারবার বলার মত দিয়েছেন: শাফেয়ী, আবু হানীফা, আহমদ ও অধিকাংশ আলেম। আর দুইবার বলার মত প্রদান করেছেন মালেক। তিনি এই হাদীসটি দলীল হিসেবে পেশ করেছেন।[সমাপ্ত]

আর আবু হানীফা ও আহমদের দলীল হলো:

আবদুল্লাহ ইবনে যাইদ হতে বর্ণিত: তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ‘নাকুস’ (ঘণ্টা ধ্বনি) দিয়ে লোকদের নামাযের জন্য একত্র করার নির্দেশ দিলেন, তখন আমি স্বপ্নে দেখতে পেলাম, এক ব্যক্তি হাতে ঘণ্টা নিয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম: হে আল্লাহর বান্দা! ঘণ্টাটি বিক্রি করবে কি? লোকটি বলল: তা দিয়ে তুমি কি করবে? আমি বললাম: আমরা এটির সাহায্যে মানুষদেরকে নামাযে ডাকবো। লোকটি বললো: আমি কি তোমাকে এর চেয়ে উত্তম জিনিস অবহিত করব না? আমি বললাম: অবশ্যই। লোকটি বলল: তুমি বলবে: “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ; আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, হাইয়্যা ‘আলাস সালাহ, হাইয়্যা ‘আলাস সালাহ। হাইয়্যা ‘আলাল ফালাহ, হাইয়্যা ‘আলাল ফালাহ, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” (অর্থ: আল্লাহ মহান, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, দুই বার। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, কোন উপাস্য সত্য নয়; আল্লাহ ছাড়া (দুই বার)। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল (দুই বার)। সলাতের দিকে আসো (দুই বার), সফলতার দিকে আসো (দুই বার), আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান ,আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই।)

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর লোকটি কিছুটা দূরে গিয়ে বলল: যখন নামাযের জন্য দাঁড়াবে তখন (ইকামাত হিসেবে) বলবে: “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আশাহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশাহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ। হাইয়্যা ‘আলাস সালাহ, হাইয়্যা ‘আলাস ফালাহ। ক্বাদ ক্বামাতিস সালাতু ক্বাদ ক্বামাতিস সালাহ। আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ।”

অতঃপর ভোর হলে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়ে স্বপ্নে দেখা বিষয়টি অবহিত করি। তিনি বললেন: “এটা সত্য স্বপ্ন, ইনশাআল্লাহ। তুমি উঠো, বিলালকে সাথে নিয়ে গিয়ে তুমি স্বপ্নে যা দেখেছো তা তাকে শিখিয়ে দাও, যেন সে (ঐভাবে) আযান দেয়। কারণ তার কণ্ঠস্বর তোমার কণ্ঠস্বরের চেয়ে উচ্চ।” অতঃপর আমি বিলালের সাথে দাঁড়ালাম এবং তাকে (আযানের বাক্যগুলো) বলে দিচ্ছিলাম আর বিলাল ঐগুলো দিয়ে আযান দিচ্ছিলেন। তখন উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজ ঘর থেকে আযান শুনতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ চাদর টানতে টানতে বের হয়ে আসলেন এবং বললেন: ‘হে আল্লাহর রসূল! ঐ মহান সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে সত্য নবীরূপে পাঠিয়েছেন, আমিও একই স্বপ্ন দেখেছি।’ তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: “সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যই।”[হাদীসটি আবু দাউদ (৪৯৯) বর্ণনা করেন। হাদীসটিকে ইবনে খুযাইমা (১/১৯১) ও ইবনে হিব্বান (৪/৫৭২) সহীহ বলেছেন। ইমাম বুখারী কর্তৃক হাদীসটি বিশুদ্ধ গণ্য করার বক্তব্য তুলে ধরেছেন তিরমিযী যেমনটি সুনানুল বাইহাকীতে (১/৩৯০) উদ্ধৃত হয়েছে।]

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা বলেন: “যদি বিষয়টি এমনই হয়ে থাকে তাহলে সঠিক মত হলো আহলুল হাদীস ও তাদের সাথে একমত পোষণকারীদের মাযহাব। সেটি হলো: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত সব কিছুকে অনুমোদিত গণ্য করা। তারা এর কোনোটিকে মাকরূহ মনে করে না। কারণ আযান ও ইকামতের ধরনের বৈচিত্র্য ক্বেরাত, তাশাহ্‌হুদ এবং অনুরূপ বিষয়াবলির বৈচিত্র্যের মতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মাহর জন্য যা সুন্নাহ করে দিয়েছেন, সেটাকে মাকরূহ গণ্য করার অধিকার কারো নেই। পক্ষান্তরে যাদের বিভেদ ও দ্বন্দ্ব এমন অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে যে তারা আল্লাহ বৈধ করেছেন এমন সমস্ত বিষয় নিয়ে মিত্রতা, বৈরিতা ও লড়াই করে। যেমনটি করে পূর্বাঞ্চলের কিছু মানুষ। তারা ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত যারা আল্লাহর দ্বীনে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং দলে দলে বিভক্তি হয়েছে। ... এ ধরণের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ সুন্নাহ হলো: কখনো একটি করা, কখনো অন্যটি করা। এক স্থানে এটি করা, অন্য স্থানে অন্যটি করা। কারণ সুন্নাহতে যা বর্ণিত হয়েছে তা পরিত্যাগ করে অন্য একটিকে আঁকড়ে ধরার ফলে সুন্নাহ বিদাতে, আর মুস্তাহাব ওয়াজিবে পরিণত হতে পারে। ফলে অন্যরা ভিন্ন কোনোটি করলে মতভেদ ও বিভক্তি দেখা দিতে পারে। সুতরাং মুসলিমের উপর ওয়াজিব হলো সামগ্রিক কানুনগুলো বিবেচনা করা যেগুলোর মধ্যে সুন্নাহ ও জামায়াতকে আঁকড়ে ধরা বিদ্যমান। বিশেষ করে জামাতের সাথে নামাযের ক্ষেত্রে। ... আযানের ক্ষেত্রে ‘তারজী’ তথা শাহাদাতাইন আস্তে বলার পর জোরে বলা মালেক ও শাফেয়ীর অভিমত। কিন্তু মালেক মনে করেন তাকবীর দুইবার বলতে হবে, আর শাফেয়ী মনে করেন তাকবীর চারবার বলতে হবে। আর এটি পরিত্যাগ করা আবু হানীফার মত। আর আহমদের মতে উভয়টি সুন্নাহ, তবে এটি পরিত্যাগ করা তার কাছে অধিক পছন্দনীয়। কারণ বিলালের (রাঃ) আযান এভাবে।

আর ইকামতে একবার করে বলা মালেক, শাফেয়ী ও আহমদের মত। তবে আহমদ এটিও বলেন যে: ইকামতে দুইবার করে বলা সুন্নাহ। আর আবু হানীফা, শাফেয়ী ও আহমদ ইকামতের বাক্য (ক্বাদ কামাতিস সালাহ) পুনরাবৃত্তি করার পক্ষে, কিন্তু মালেকের মতে একবারই বলতে হবে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।”[মাজমুউল ফাতাওয়া (২২/৬৬-৬৯)]

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব