মঙ্গলবার 22 যুলক্বদ 1446 - 20 মে 2025
বাংলা

উপহার প্রদানের কিছু ধরন সম্পর্কে তার জিজ্ঞাসা, এগুলো কি হারাম ঘুষের অন্তর্ভুক্ত হবে?

প্রশ্ন

আমি সরকারি চাকুরিজীবী একজন নারী। কর্মক্ষেত্রে আমার বেশ কিছু বান্ধবী আছেন। আমাদের মাঝে উপহার আদানপ্রদানের হুকুম কী? হোক তা বিয়ে উপলক্ষে কিংবা পারস্পরিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধির জন্য? উল্লেখ্য, আমাদের মাঝে কোনো স্বার্থ নেই। আমাদের কেউ অন্য কারো বস নয়। বরং আমরা সবাই একই মর্যাদার পদবীতে চাকুরি করি। আমি শুচিবায়ুগ্রস্ত একজন মানুষ। সব কিছুতে বেশি ঘাটাঘাটি করি। উপহার আর ঘুষের মাঝে পার্থক্য করতে পারি না। আমি এই প্রশ্নটিও করতে চাই: আমি মাঝে মাঝে চকলেট নিয়ে আসি। আমার বিভাগের সকল নারী কর্মকর্তাকে সেটি উপহার দিই। আমি কি আমাদের মহিলা বসকেও এই উপহার দিতে পারব? নাকি এটা জায়েয হবে না? আমি এ প্রশ্নও করতে চাই: আমার মা প্রায় দুই বছর আগে মারা গেছেন। তিনি যখন হাসপাতালে ছিলেন তখন প্রায়ই আমরা চকলেট, মা’মূল বিস্কুট বা এ জাতীয় কিছু নিয়ে যেতাম। আমি যদি ভুল না করে থাকি, তাহলে কয়েকবার টাকা-পয়সাও নিয়ে গিয়েছি এবং নার্সদেরকে দিয়েছি যাতে করে তারা ভালোমত আমার মায়ের দেখাশোনা করে। যদিও আমি সে সময়ে এক মুহূর্তের জন্যও ভাবতাম না যে এটি ঘুষ। এখন আমার অতীতের কথা স্মরণ করলে মনে হয় যে এটি ঘুষ। এ নিয়ে আমি অনুতপ্ত এবং আমি লানতপ্রাপ্ত হতে চাই না। আমি যদি এই পাপ ছেড়ে দিই এবং অনুতপ্ত হই তাহলে আমার রব আমার তাওবা কবুল করার জন্য আমার উপর আর কী কী করা আবশ্যক? আমার গত দুই বছরের নামায এবং রোযার কি কোনো সমস্যা হবে?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

উপহার দেয়া মুস্তাহাব; যেহেতু উপহারের মাধ্যমে পারস্পরিক সৌহার্দ্য তৈরি হয় এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ দৃঢ় হয়।

আর ঘুষ হারাম বিষয়; যেহেতু এর মাধ্যমে যুলুম করা হয়, অন্যের অধিকার খর্ব করা হয় এবং স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার ভিত প্রতিষ্ঠা করা যায়।

সুতরাং এ দু’টির মধ্যকার পার্থক্য স্পষ্ট। কোনো ব্যক্তিকে ভালোবাসার কারণে তাকে উপহার প্রদান করা হয়। অন্যদিকে ব্যক্তি ঘুষ প্রদান করে যাতে করে সে তার অধিকার নয় এমন কিছু অর্জন করতে পারে অথবা নিজের কোনো অধিকার বাতিল করতে পারে।

আর চাকুরিজীবীদের যে উপহার দেওয়া হয় সেটি যদি কর্মক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতার কারণে প্রদান করা হয়, যেমন: সে যদি বস বা বিচারক হয়, তাহলে এমন উপহার দেয়া হারাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটি প্রদান করতে নিষেধ করেছেন। কারণ এই উপহার বস অথবা বিচারকের নৈকট্য অর্জনের জন্য উপহারদাতার একটি মাধ্যম হতে পারে। ফলে পরিচালক তার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে এবং এমন কিছু তাকে দিয়ে দিবে যা পাওয়ার অধিকার তার নেই।

এর উপর ভিত্তি করে বলা যায়, একজন চাকুরিজীবী কর্মক্ষেত্রে তার বান্ধবীকে যা প্রদান করে সেটি উপহার; ঘুষ নয়। কেননা এটির কারণ বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা। যাকে উপহার দেওয়া হলো তার এমন কোনো কর্তৃত্ব নেই যার দ্বারা তার পক্ষ থেকে উপহার প্রদানকারীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার আশা করা যায়। অন্যদিকে বসকে প্রদত্ত উপহার ঘুষ কিংবা ঘুষের মাধ্যম। কারণ চাকুরীজীবী নারীদের উপর পরিচালকের ক্ষমতা আছে। এই উপহার তার কিছু সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ বিধায় (139393) নং ফতোয়াটি পড়ুন।

তবে যৎসামান্য বিষয় (যেমন: চকলেট বিতরণ) মানুষ স্বাভাবিকভাবে করে থাকে। তারা এটাকে ঘুষ মনে করে না। বিশেষতঃ যদি বসকে বিশেষভাবে কিছু না দিয়ে সকল কর্মচারীর মাঝে বিতরণ করা হয়। সকলকে দেওয়া হলেও বসকে না দেওয়া হয় কোনোভাবে উচিত হবে না এবং খুবই বেমানান হবে!!

দুই:

চিকিৎসক অথবা নার্সকে রোগী বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো উপহার দেওয়া উচিত হবে না। কারণ এতে করে নার্স ঐ রোগীকে বেশি গুরুত্ব দেয়। ফলস্বরূপ অন্য সব রোগীকে কম গুরুত্ব দেয়। কখনো এমন হয়ে যায় যে ঐ নার্সকে এই উপহার না দিলে সে রোগীদের প্রতি তার আবশ্যকীয় দায়িত্ব পালন করে না।

তবে সামান্য বিষয়গুলো এক্ষেত্রে উপেক্ষা করা যায়। যেমন: চকলেট ও অন্যান্য বিষয় সাধারণত মানুষ যা সহিষ্ণুভাবে দেখে।

শাইখ আব্দুল আযীয ইবনে বায রাহিমাহুল্লাহু তায়ালাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল:

‘চিকিৎসা করার পর ডাক্তারকে উপহার হিসেবে যা দেওয়া হয় সেটির বিধান কী? এটি কি বৈধ তথা জায়েয; নাকি হারাম?’

তিনি উত্তর দেন: “যদি ডাক্তার সরকারী হাসপাতাল অথবা সরকারী ক্লিনিকে চাকুরি করে তাহলে তাকে কিছু দেওয়া যাবে না। কিন্তু, যদি কাজ শেষ করার পর কোনো রকমের পূর্ব প্রতিশ্রুতি ছাড়া দেওয়া হয় তাহলে সম্ভবত কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এটি ত্যাগ করাই নিরাপদ। এমনকি যদিও চিকিৎসার পরে এটি দেওয়া হয়। কারণ ভেতর থেকে সে এর সাথে খাপ খেয়ে যেতে পারে। তখন তাকে বেশি গুরুত্ব দিবে, আর অন্যদেরকে অবহেলা করবে। আমার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে তাকে কিছুই না দেওয়া; এমনকি চিকিৎসা শেষ হওয়ার পরেও। যাতে করে এই পথ রুদ্ধ করে রাখা যায় এবং নানারকম কৌশল রুখে দেওয়া যায়। অতএব, তাকে কোনো কিছু দেওয়া উচিত হবে না। বরং তার জন্য দোয়া করবে। তার জন্য দোয়া করবে আল্লাহ যেন তাকে তৌফিক দান করেন এবং সাহায্য করেন। এবং এভাবে বলবে: জাযাকাল্লাহু খাইরা (আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন)। আমরা এই ভালো কথার মাধ্যমে আপনার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য ও তৌফিক প্রার্থনা করছি।”[সমাপ্ত][নূরুন আলাদ্দারব: (১৯/৩৮০-৩৮১)]

ইতঃপূর্বে এই ওয়েবসাইটের (83590) নং ফতোয়ায় বর্ণনা করা হয়েছে যে: চাকুরি করার কারণে চাকুরিজীবীদেরকে মানুষদের উপহার প্রদান করা জায়েয নেই। 

যদি মুসলিম কোনো হারাম কাজ করে অথচ সে জানে না যে এটি হারাম তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ فِيمَا أَخْطَأْتُمْ بِهِ وَلَكِنْ مَا تَعَمَّدَتْ قُلُوبُكُمْ وَكَانَ اللَّهُ غَفُوراً رَحِيماً

“তোমরা ভুল করলে তোমাদের কোনো পাপ হবে না। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যায় করলে ভিন্ন কথা (পাপ হবে); আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[সূরা আহযাব: ৫]

এই বিধান যে জানে না সে ইচ্ছাকৃত পাপ করেনি। এটি আপনার পূর্ববর্তী ইবাদত তথা নামায ও রোযাকে প্রভাবিত করবে না। যে ব্যক্তি ইতঃপূর্বে সুদ খেয়েছে তার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

فَمَنْ جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّهِ فَانْتَهَى فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ وَمَنْ عَادَ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

“প্রভুর কাছ থেকে উপদেশ আসার পর কেউ যদি (সুদ খাওয়া থেকে) বিরত হয় তাহলে আগে যা (নেওয়া) হয়েছে তা তারই থাকবে এবং তার বিষয়টি (ফয়সালার ভার) আল্লাহর কাছে (ন্যস্ত থাকবে)। আর যারা ফিরে যাবে (অর্থাৎ পুনরায় সুদ খাবে) তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।”[সূরা বাকারা: ২৭৫]

হে আল্লাহর বান্দী! জেনে রাখুন, আপনি যা উল্লেখ করেছেন তার সাথে আপনার ইবাদত এবং আনুগত্যের কোনো সম্পৃক্ততা নেই; হোক সেটি নামায, রোযা, যাকাত অথবা অন্য কিছু। হোক সেটি আপনার দ্বারা সংঘটিত বৈধ কিংবা হারাম কাজ। আপনি যে আমলই করেন না কেন, অন্য কোনো ভুল করার কারণে সেটি নষ্ট হবে না। তাহলে যেখানে আপনি ভুল করার সময় সেটি ভুল হিসেবে জানতেনই না সেটির ক্ষেত্রে কী করে হয়? আর যদি বিষয়টি বাস্তবে বৈধ-ই হয়ে থাকে, কোনো ভুল না হয়ে থাকে, সেটির ক্ষেত্রে কী করে হতে পারে?!

আপনাকে আমরা এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে উপদেশ দিব সেটি হলো: আপনি এই সমস্ত ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) থেকে পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নিবেন। আল্লাহর কাছে এর থেকে পানাহ চাইবেন। এগুলোর দিকে ফিরেও তাকাবেন না। এগুলোকে পরোয়া করবেন না। এগুলো যখন আপনাকে পেয়ে বসবে তখন আপনার দুনিয়া ও আখিরাত ধ্বংস করে দিবে।

আমাদের ওয়েবসাইটে ওয়াসওয়াসা এবং এর চিকিৎসা সম্পর্কে বহু উত্তর রয়েছে, সেগুলো দেখা এবং সেগুলো থেকে উপকৃত হওয়ার অনুরোধ রইল। আমরা আপনাকে এ পরামর্শও দিবো, আপনি নির্ভরযোগ্য কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাবেন। কারণ উভয় প্রকার চিকিৎসার মাঝে সমন্বয় ঘটালে তথা জ্ঞানগত, আচরণগত ও ঈমানী চিকিৎসার সাথে সাথে বস্তুগত ডাক্তারি চিকিৎসার সমন্বয় ঘটালে আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন এবং ওয়াসওয়াসার অবসাদ থেকে আপনাকে নিস্তার দিবে, ইন শা আল্লাহ।

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব