মঙ্গলবার 5 রবীউছ ছানী 1446 - 8 অক্টোবর 2024
বাংলা

ক্রয়-বিক্রয় ও আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ফিকহ শেখা কি ওয়াজিব?

প্রশ্ন

ফার্মাসিস্ট ও ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের মত যারাই ক্রয়-বিক্রয় করে তাদের

উপর কি ক্রয়-বিক্রয় ও আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ফিকহ শেখা ওয়াজিব (ফরযে আইন)?

আলহামদু লিল্লাহ।.

যখন একজন মুসলিম জানবে যে দুনিয়ার জীবনে তাকে সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর নির্দেশ ও তাঁর শরীয়ত (আইন) মেনে চলা এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা তখন সে এটাও জানবে যে তার উপর আল্লাহর শরীয়তের বিধি-বিধান শেখা ও দায়িত্বসমূহ জানা আবশ্যক। কারণ যেটা ছাড়া কোন ওয়াজিব সম্পন্ন করা যায় না সেটাও ওয়াজিব।

হাদীসে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: প্রত্যেক মুসলিমের উপর ইলম অন্বেষণ করা ফরয। [হাদীসটি ইবনে মাজাহ (২২৪) বর্ণনা করেন। বর্ণনার বহু সনদ ও শাহেদ (সমার্থক) হাদীস দ্বারা মিয্‌যী, যারকাশী, সুয়ূত্বী, সাখাভী, যাহাবী, মুনাওয়ী ও যারক্বানী উক্ত হাদীসকে হাসান বলেছেন। এটা শাইখ আলবানীর সহীহ ইবনে মাজাহতে রয়েছে]

আলেমরা উক্ত হাদীসের অর্থকে সহিহ বলে গণ্য করেছেন।

ইবনে আব্দিল বার রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “হাদীসটির ব্যাপারে তারা কাছাকাছি রকমের মতভেদ করলেও এর অর্থ তাদের কাছে সঠিক।”[সমাপ্ত][জামেউ বায়ানিল ইলম: (১/৫৩)]

অনুরূপ বক্তব্য ইমাম নববী তার ‘মানসূরাত’ বইয়ে (পৃ. ২৮৭) এবং ইবনুল কাইয়িম তার ‘মিফতাহু দারিস সায়াদাহ’ বইয়ে (১/৪৮০) বর্ণনা করেছেন। ইবনে আব্দিল বার বলেন:

“আলেমরা সবাই ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, কিছু জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ফরযে আইন। আর কিছু ইলম আছে ফরযে কিফায়া; যা কিছু ব্যক্তি অর্জন করলে ঐ স্থানের সকল অধিবাসীর ফরযিয়তের দায় মুক্ত হয়ে যাবে।”[সমাপ্ত] [জামেউ বায়ানিল ইলমি ওয়া-ফাদলিহি (১/৫৬)]

যে ইলম অর্জন করা ফরযে আইন আলেমরা সেটার বিবরণ দিয়েছেন এবং প্রত্যেক মুসলিমের উপর যতটুকু পরিমাণ ইলম অর্জন ফরযে আইন তারা সেটা নিয়ে কথা বলেছেন। এর মধ্যে তারা উল্লেখ করেছেন যে: যিনি ব্যবসা করেন তার জন্য ক্রয়-বিক্রয়ের বিধি-বিধান জানা ফরয; যাতে করে তিনি নিজের অজান্তে হারামে বা সুদে জড়িয়ে না পড়েন। কিছু সাহাবীর থেকে এমন কিছু উদ্ধৃতি বর্ণিত হয়েছে যা এই বক্তব্যকে জোরদার করে।

উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “আমাদের বাজারে শুধু ঐ ব্যক্তি বিক্রয় করতে পারবে যে দ্বীনী জ্ঞানে প্রজ্ঞা অর্জন করেছে।”[উক্তিটি তিরমিযী (৪৮৭) বর্ণনা করেছেন এবং হাসান গরীব বলেছেন। শাইখ আলবানী সহীহুত তিরমিযীতে এটাকে হাসান বলেছেন]

আলী ইবনে আবী ত্বালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “যে ব্যক্তি ফিকহ শেখার আগে ব্যবসা করতে গেল সে সুদের মাঝে পড়ে গেল, তারপর সুদের মাঝে পড়ে গেল, তারপর আবার সুদের মাঝে পড়ে গেল।” অর্থাৎ সে সুদে জড়িয়ে পড়ে।”[মুগনিল মুহতাজ (২/২২)]

ইবনে আব্দিল বার বলেন:

“সবার জন্য যা অনিবার্য তা হলো— ফরয ইলম। তন্মধ্যে রয়েছে: ব্যক্তির উপর ফরয হওয়া বিষয়গুলোর যতটুকু তার না জানলেই নয়:

যেমন: মুখে সাক্ষ্য দেওয়া এবং অন্তর দিয়ে স্বীকৃতি দেওয়া যে আল্লাহ এক; তাঁর কোনো শরীক নেই। ...তিনি তাঁর নাম ও গুণাবলিসহ অনাদি থেকে বিদ্যমান। তার সূচনার কোনো শুরু নেই এবং তাঁর শেষের কোনো সমাপ্তি নেই। তিনি আরশের ঊর্ধ্বে উঠেছেন।

এবং এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে—

মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, মৃত্যুর পর আমলের প্রতিদান দেয়ার জন্য পুনরুত্থান করানো হবে, কুরআন আল্লাহর বাণী এবং এতে যা কিছু আছে তা সত্য।

পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয। নামাযের জন্য পবিত্রতা ও নামাযের বিধিবিধানের যতটুকু ইলম না থাকলে নামায সম্পাদন করা যাবে না ততটুকুর জ্ঞান তার উপর আবশ্যকীয়।

রমযানের রোযা ফরয। রোযা ভঙ্গকারী বিষয়াবলীর জ্ঞান এবং যতটুকু না জানলে রোযা সম্পাদন করা যাবে না ততটুকু জানা তার উপর আবশ্যকীয়।

যদি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হয় এবং হজ্জ করার সক্ষমতা থাকে তাহলে কোন কোন সম্পদে যাকাত ফরয হয়, কখন ফরয হয়, কতটুকু সম্পদ ফরয হয়— এসব জানা তার উপর আবশ্যকীয় এবং এটা জানাও তার উপর আবশ্যকীয় যে, হজ্জে যাওয়ার সক্ষমতা থাকলে তার উপর জীবনে একবার হজ্জ আদায় করা ফরয।

এছাড়াও এমন আরো কিছু বিষয় আছে যেগুলো সমষ্টিগতভাবে জানা আবশ্যক; যেগুলোর ক্ষেত্রে অজ্ঞতার ওজর (কৈফিয়ত) গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন: ব্যভিচার ও সুদ হারাম হওয়া। মদ, শুকর, মৃত প্রাণী ও সকল নাপাকী খাওয়া হারাম হওয়া। জবরদখল, মিথ্যা সাক্ষ্য, অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ ও সব ধরনের যুলুম হারাম হওয়া। মা-দেরকে, বোনদেরকে এবং তাদের সাথে অন্য যাদেরকে উল্লেখ করা হয়েছে তাদেরকে বিবাহ করা হারাম হওয়া। কোন মুমিনকে অন্যায়ভাবে হত্যা হারাম হওয়া।

এমন আরো যা কিছু কুরআনে এসেছে এবং যার উপর উম্মাহ ঐকমত্য পোষণ করেছে।”[জামেউ বায়ানিল ইলম: (১/৫৭) থেকে সমাপ্ত]

আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যাতে (৩০/২৩৯) এসেছে:

“আলামী থেকে নকল করে ইবনে আবিদীন বলেন:

প্রত্যেক শরয়ি ভারপ্রাপ্ত মুমিন নর-নারী দ্বীন ও হেদায়াতের ইলম অর্জন করার পর তার উপর অযু, গোসল, নামায ও রোযার ইলম এবং নিসাবের মালিক হলে যাকাতের ইলম এবং হজ্জ ওয়াজিব হলে হজ্জের ইলম শেখা ফরয।

ব্যবসায়ীদের উপর ক্রয়-বিক্রয়ের ইলম শেখা আবশ্যক; যাতে তারা লেনদেনের ক্ষেত্রে সংশয়পূর্ণ ও মাকরুহ বিষয়াবলী থেকে বেঁচে থাকতে পারে। অনুরূপভাবে পেশাজীবীদের এবং প্রত্যেক যে ব্যক্তি যে কাজ করেন সেটার জ্ঞান ও বিধান জানা তার উপর আবশ্যক; যাতে করে সে ঐ কাজে হারাম থেকে বেঁচে থাকতে পারে।

নববী বলেন: ক্রয়-বিক্রয়, বিবাহ বা অনুরূপ যে সকল বিষয় মৌলিকভাবে আবশ্যক নয় সেগুলোর শর্তসমূহ জানার আগেই সেগুলোর দিকে অগ্রসর হওয়া হারাম।”[সমাপ্ত]

গাযালী রাহিমাহুল্লাহ বলেন:

অনুরূপভাবে এই মুসলিম ব্যক্তি যদি ব্যবসায়ী হয় এবং তার দেশে সুদী লেনদেনের বিস্তার থাকে তার উপর সুদ থেকে সতর্ক থাকার বিষয়টা শেখা আবশ্যক। ফরযে আইন ইলমের ক্ষেত্রে এটাই সঠিক। এর অর্থ হলো— ওয়াজিব আমল আদায় করার পদ্ধতি জানা।”[ইহয়াউ উলূমিদ্দীন: (১/৩৩) থেকে সমাপ্ত]।

আলী ইবনুল হাসান ইবনে শাকীক একবার ইবনুল মুবারককে বললেন:

“কোন সে ইলম যা অন্বেষণ করা ছাড়া মুমিনের কোন গত্যন্তর নেই? কোন সে ইলম যা শেখা মুমিনের উপর আবশ্যক?

তিনি বললেন: “ইলম ছাড়া কোনো কিছুর দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ নেই। জিজ্ঞাসা করা ছাড়া তার কোন গত্যন্তর নেই।”[ইবনু আব্দিল বার ‘জামেউ বায়ানিল ইলম’ বইয়ে (১/৫৬) বর্ণনা করেছেন]।

গাযালী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “প্রত্যেক বান্দা দিবানিশি ইবাদত ও লেনদেনে তার উপর অনিবার্য নতুন কিছু বিষয়ের সম্মুখীন হয়। তাই তার কর্তব্য হলো বিরল যা কিছু তার ক্ষেত্রে ঘটে সেগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা এবং নিকট ভবিষ্যতে সে যা কিছু ঘটার সম্ভাবনা দেখে অবিলম্বে সেই ইলম অর্জন করাও তার উপর অনিবার্য।”[ইহয়াউ উলূমিদ্দীন (১/৩৪) থেকে সমাপ্ত]

যিনি ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয়ে জড়াবেন তার জন্য উপদেশ হলো— লেনদেনের ফিকাহ বিষয়ক কিছু সংক্ষিপ্ত বই তিনি পড়বেন। যেমন: শাইখ সালিহ ফাওযানের “আল-মুলাখ্‌খাসুল ফিকহী” এবং উস্তায আব্দুল্লাহ মুসলিহ ও সালাহ সাওয়ীর “মা লা ইয়াসাউত তাজিরা জাহলুহু” বই।

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

আরো দেখুন (20092 ) নং প্রশ্নোত্তর।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

সংশ্লিষ্ট প্রশ্নোত্তরসমূহ