নিয়তের পরিশুদ্ধি আমল কবুলের ভিত্তি
কোনো আমল করার সূচনালগ্নে একজন মুসলিমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টিতে মনোযোগ দেয়া উচিত সেটা হচ্ছে নিয়তের কথা স্মরণ করা ও নিয়তকে পরিশুদ্ধ করা।কারণ আমল কবুল হওয়া কিংবা প্রত্যাখ্যান হওয়া নিয়তের উপরই নির্ভর করছে। নিয়তকে কেন্দ্র করেই অন্তর পরিশুদ্ধ হয় কিংবা নষ্ট হয়।
কেউ যদি নিজ আমলে সঠিক নিয়ত করতে চায় তাহলে অবশ্যই তাকে ভেবে দেখতে হবে যে কোন বিষয়টি তাকে এই আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করছে। তার আমলের উদ্দেশ্য যেন হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা, তাঁর আনুগত্য করা এবং তাঁর নির্দেশ পালন করা। এভাবেই তার নিয়ত কেবল আল্লাহর জন্য হবে। এরপর তার কর্তব্য হলো আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ এই মূল কর্মপ্রেরণাকে সংরক্ষণ করা। তাই আমলকালীন সে অন্যদিকে ফিরবে না। তার অন্তর ও নিয়ত বদলে ফেলবে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দিকে সে ঝুঁকবে না। অন্য কোনো কিছুকে সে অংশীদার করবে না।
আমলে একনিষ্ঠতার মূলনীতিসমূহ
বান্দার আমল যে নিষ্ঠাপূর্ণ এবং সে যে কেবল আল্লাহর জন্য এই আমলটি করছে সেটি সে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মেনে চলার মাধ্যমে জানতে সক্ষম হবে:
- ব্যক্তি কোনো কাজ এই উদ্দেশ্যে করবে না যে, মানুষজন তাকে দেখবে এবং তার ব্যাপারে শুনবে।
বুখারী (৬৪৯৯) ও মুসলিম (২৯৮৭) জুন্দুব (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি লোক-শুনানোর উদ্দেশ্যে আমল করবে আল্লাহ তার ব্যাপারে মানুষকে শুনিয়ে দিবেন। আর যে ব্যক্তি লোক-দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করবে আল্লাহ তার বিষয়টি দেখিয়ে দিবেন।”
হাফেয ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেন:
খাত্তাবী বলেছেন: হাদিসটির অর্থ হলো: যে ব্যক্তি ইখলাস তথা নিষ্ঠা ছাড়া কোনো আমল করবে এবং তার আমলের নিছক উদ্দেশ্য হবে মানুষকে দেখানো ও শোনানো; এর ফলস্বরূপ আল্লাহ তার প্রকৃত অবস্থা জনসম্মুখে ফাঁস করে দিবেন, তাকে কলঙ্কিত করবেন এবং সে যা গোপন করে রেখেছিল তা তিনি প্রকাশ করে দিবেন।
অন্য আরেকটি ব্যাখ্যা হচ্ছে: যে ব্যক্তি তার আমলের মাধ্যমে মানুষের কাছে প্রভাব-প্রতিপত্তি ও গ্রহণযোগ্যতা পেতে চাইবে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য করবে না; আল্লাহ তাকে সে সকল মানুষের কাছে আলোচনার পাত্র বানিয়ে দিবেন যাদের কাছে সে মর্যাদা পেতে চাইছিল। তবে তার জন্য আখিরাতে কোনো নেকী থাকবে না।”[ফাতহুল বারী (১১/৩৩৬) থেকে সমাপ্ত]
আল-ইযয ইবনে আব্দুস সালাম বলেন: ‘নেক আমল গোপন রাখা মুস্তাহাব হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অবস্থা হলো: কেউ যদি এ উদ্দেশ্যে আমল প্রকাশ করে যাতে তার অনুসরণ করা হয় কিংবা তার থেকে (লোকে) উপকৃত হতে পারে। যেমন: জ্ঞান লিখে রাখা।’[সমাপ্ত][ফাতহুল বারী (১১/৩৩৭)]
- তার ব্যাপারে মানুষের প্রশংসা অথবা নিন্দার সাথে যেন তার অন্তর জুড়ে না যায়।
ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “বান্দার কদম যখন বিনয়ের স্তরে স্থিতিশীল হয় ও সুদৃঢ় হয়; তখন তার হিম্মত উন্নত হয় এবং তার আত্মা প্রশংসা ও নিন্দার হাতছানির উর্ধ্বে উঠে যায়। তখন সে মানুষের প্রশংসায় আনন্দিত হয় না এবং মানুষের নিন্দায় মনোকষ্ট পায় না। এটি এমন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য যে কুপ্রবৃত্তির প্রভাব থেকে বের হতে পেরেছে, নিজ রবের ইবাদত করার জন্য প্রস্তুত হয়েছে এবং যার অন্তর ঈমান ও দৃঢ় বিশ্বাসের সুমিষ্ট স্বাদ অর্জন করেছে।”[সমাপ্ত][মাদারিজুস সালিকীন (২/৮)]
- আমল প্রকাশ্যে করার চেয়ে গোপনে করা তার কাছে বেশি পছন্দনীয় হবে।
আসেম বর্ণনা করেন: “আবু ওয়ায়েল যখন নিজ বাড়িতে নামায পড়তেন তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন। কিন্তু কেউ তাকে দেখছে এমন সময়ে যদি এটি করার জন্য তাকে সমগ্র দুনিয়াও দেওয়া হত তবুও তিনি তা করতেন না।”[হাদীসটি আহমদ বর্ণনা করেন তার ‘আয-যুহদ’ (পৃ. ২৯০) বইয়ে]
- প্রসিদ্ধি ও খ্যাতির স্থানগুলো থেকে সে দূরে থাকার চেষ্টা করবে; তবে যদি এর মাঝে কোন শরয়ি কল্যাণ থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।
ইব্রাহীম ইবনে আদহাম রাহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘যে ব্যক্তি খ্যাতিমান হতে চায় সে আল্লাহর সাথে সৎ নয়।’ [ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন: ৩/২৯৭]
বলা হয়: ‘ইখলাস হচ্ছে প্রকাশ্যে ও গোপনে বান্দার আমলসমূহ সমান সমান হওয়া। আর লৌকিকতা হচ্ছে তার প্রকাশ্য অবস্থা গোপন অবস্থার চেয়ে উত্তম হওয়া।’[মাদারিজুস সালিকীন (২/৯১)]
- নিজেকে সবসময় অভিযুক্ত করে যাবে, নিজের কোনো কৃতিত্ব আছে বলে মনে করবে না। সে এটা জানবে যে সমস্ত অনুগ্রহ আল্লাহর। আল্লাহর অনুগ্রহ না থাকলে সে ধ্বংস হয়ে যেত।
আল্লাহ তা’আলা বলেন:
وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ مَا زَكَى مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ أَبَدًا وَلَكِنَّ اللَّهَ يُزَكِّي مَنْ يَشَاءُ
“যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকত তাহলে তোমাদের কেউ কখনো পরিশুদ্ধ হতে পারতে না। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পরিশুদ্ধ করেন।”[সূরা নূর: ২১]
- আমল করার পর ঘাটতির কথা অনুভব করে বেশি বেশি ইস্তিগফার করবে।
সাদী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “বান্দার করণীয় হচ্ছে কোনো ইবাদত সমাপ্ত হলে আল্লাহর কাছে ঘাটতির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। আমল করার তৌফিক লাভের কারণে কৃতজ্ঞতা পোষণ করা। সে ঐ ব্যক্তির মতো হবে না যে মনে করে ইবাদত পূর্ণ করার মাধ্যমে সে আল্লাহর প্রতি অনুগ্রহ করেছে এবং এই ইবাদতের মাধ্যমে সে উঁচু মর্যাদা অর্জন করে ফেলেছে। এমন ব্যক্তি ঘৃণিত হওয়ার উপযুক্ত। অন্যদিকে প্রথম ব্যক্তির (যে কৃতজ্ঞ হয়) আমল কবুল হওয়া এবং সে অন্যান্য আমল করার তৌফিক লাভের উপযুক্ত হয়।”[সমাপ্ত][তাফসীরুস সা’দী: পৃ. ৯২]
- নেক কাজ করার ব্যাপারে আল্লাহর তৌফিক লাভের দরুন আনন্দিত হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ
“বলো: (তা) আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে (এসেছে); অতএব তারা যেন এতে আনন্দিত হয়। তারা যা সঞ্চয় করেছে তার চেয়ে তা উত্তম।”[সূরা ইউনুস: ৫৮]
সুতরাং যে ব্যক্তি নিজ আমলে এগুলো মেনে চলে সে ব্যক্তি মুখলিস বা একনিষ্ঠদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশা পোষণ করা যায়।
কিন্তু আমল একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য সম্পাদিত হয়েছে এটি অকাট্যভাবে বলা সম্ভবপর নয়। কারণ এর জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে। কিন্তু বান্দা ইখলাসের উপায়গুলো অবলম্বন করবে এবং আল্লাহর কাছে নেক আমলের জন্য তৌফিক প্রার্থনা করবে। কিন্তু সে নিজের ব্যাপারে কিংবা অন্য কারো ব্যাপারে ইখলাসের নিশ্চয়তা প্রদান করবে না।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।